Sun, 11/09/2011 - 1:25am | by Shawnchoy.Rahman
হঠাৎ করেই ইমেইলে একটি চমৎকার ট্যুর-এর ডিল পেলাম। ভ্রমণ যেহেতু আমার নেশা, তাই হয়তবা বিভিন্ন সাইটে সাবসক্রাইব করে রেখেছিলাম অথবা পূর্বের কোন ট্যুর কোম্পানির সাথে ট্যুর করার পর তারা আমার ইমেইল সেইভ করে রেখেছিল। যাই হোক, এটি ২ দিন, ১ রাতের বোস্টন, রোড আইল্যান্ড ট্যুর। জন-কে ফোন দিলাম, জন রাজী হয়ে গেল। আমার কাজিন শান্ত-কে বললাম যে, আমি বোস্টন, রোড আইল্যান্ড যাচ্ছি। শান্ত-ও যেতে চাইল। আমি লেবার ডে উইকেন্ড-এর পূর্ণ সুবিধাটা নিতে চাইলাম। যেহেতু, শনি-রবি এমনিতেই বন্ধ, আর সোমবার লেবার ডে উইকেন্ড-এর ছুটি তাই আমি শুক্রবার-ও ছুটি নিয়ে নিলাম। আমার ছুটিটি ৪ দিনের দীর্ঘ ছুটিতে পরিণত হল- উদ্দেশ্য হল আমার পুরনো জায়গা নিউইয়র্ক সিটিতে বোস্টন ট্যুরের আগে ও পরে কিছু সময় কাটানো।
এবারের ট্যুর-টিতে নিজেরা কোনরকম ড্রাইভ না করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তাই ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রথমে নিউইয়র্ক বাসে যাওয়া ঠিক করলাম।শান্ত শুক্রবার ছুটি নিতে পারলনা কিন্তু একটু আগে অফিস থেকে বের হয়ে গেল। আমরা সন্ধ্যা ৬টার বাস ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় ওয়াশিংটন ডিসি-র চায়না টাউন পৌঁছলাম।
চায়না টাউনের বাস খুবই সস্তায় নিউইয়র্ক নিয়ে যায়।২০০৮-এ একবার গিয়েছিলাম। আসার সময়ে যে পরিমাণ কষ্ট করেছিলাম , তাতে ঠিক করেছিলাম যে আর কখনোই চায়না টাউনের বাস নয়। কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় তিনটি বছর কেটে গিয়েছে। বন্ধু-বান্ধব অনেকেই নিউইয়র্ক থেকে এসেছে, গিয়েছে। আমি তাদেরকে বাস-স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে এসেছি, আবার দিয়েও এসেছি। সবার কাছ থেকে প্রশংসাই শুনেছি। ভাবলাম তিন বছরে চায়না টাউনের বাস সার্ভিস নিশ্চয়ই উন্নতি হয়েছে। তাছাড়া লেবার ডে উইকেন্ড হওয়াতে অন্যান্য বাসের (মেগা, বোল্ট, গ্রে-হাউন্ড) টিকিট sold out। যাই হোক, আমরা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাস-স্ট্যান্ডে হাজির। ৪০ ডলার দিয়ে দুটি টিকেট কিনলাম। খুবই সস্তা। চায়না টাউনের বাসের নিজস্ব বাস-স্ট্যান্ড নেই।টিকিট যেখানে বিক্রি করে, তার সামনের রাস্তা থেকেই বাস ছাড়ে।আমাদের বাস ৬ টায় ছাড়বে। ঘড়ির কাটায় ৬ টা বেজে গেল, বাস আসছে না। ভাবলাম মিনিট দশেকের মধ্যে হয়তবা আসবে। সোয়া ছয়, সাড়ে ছয়, সাতটা বেজে গেল - কোন খবর নাই। রাস্তায় মানুষের ভিড়। কাউন্টারে আমি ও আরো দুজন গেলাম বাসের কথা জিজ্ঞেস করার জন্য। সেখানে যে মহিলা বসে আছে, তার ব্যবহার খুবই রুক্ষ। সে কোন কথাই বলতে চায় না। বার বার জিজ্ঞেস করার পর বলল, আরেকটু পর আসবে। বাসের এই সার্ভিসের জন্য তার মধ্যে লজ্জিত হওয়া বা ক্ষমা চাওয়া কোনটাই দেখা গেল না। অবশেষে ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে সাতটায় আরেকটি বাস ছাড়ার কথা ছিল, সেটার যাত্রীরাও একই লাইনে দাঁড়াল। সাড়ে সাতটায় একটি বাস নিউইয়র্ক থেকে এলো। আগত যাত্রীরা নেমে যাবার সাথে সাথেই সেই বাসে সবাই হুমড়ি খেয়ে উঠতে লাগল।আমি ও শান্ত বাসে উঠার যুদ্ধে হার মানলাম। বাস আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমেরিকার মত দেশে এটি কল্পনাই করা যায় না, কিন্তু এই ব্যাপারটি চোখের সামনে ঘটে গেল। উল্লেখ্য এই বাসের যাত্রীদের অধিকাংশই চাইনিজ, কোরিয়ান, ভিয়েতনামিজ, কালো। কাউন্টারের ঐ মহিলা এসে বলল যে আরেকটি বাস আসছে। আবার অপেক্ষার পালা। আরো একটি ঘণ্টা পার হওয়ার পর সাড়ে আটটায় আরেকটি বাস এলো। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, এবার যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে। বিনা যুদ্ধে অন্য-যাত্রীদেরকে উঠতে দিব না। যুদ্ধে জয়ী হলাম। বাসে উঠে শেষের দিকে আমরা কোনমতে দুটি আসন পেয়ে গেলাম।চীন বা ভারতের অর্থনীতির উত্থান নিয়ে অনেক বড় বড় কথা শুনেছি, শুনি। এমনকি এটাও শুনি যে, এরাই হয়তবা ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে শাসন করবে। আমার সন্দেহ - কোনকালে পারবে কিনা, পারলেও আগামী ২০০ বছরে সম্ভব কিনা? একটি জাতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে বড় হয়ে গেলেই বড় হয়ে যায় না। তাদের ভদ্রতাবোধ, সৌজন্যতা, নিয়ম-শৃঙ্খলাও শিখতে হয়। এই আমেরিকাতেই যখন এটা তাদের মধ্যে দেখতে পেলাম না, তাদের নিজেদের দেশে কী ভয়ানক অবস্থা তা সহজেই বোঝা যায়। বছর কয়েক আগে শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম।সেখানকার মানুষের মধ্যেও একই ব্যাপার দেখেছি। অবশ্য ব্যতিক্রম থাকতেও পারে। যাইহোক্, কোনরকমে বাসের মধ্যে ৫ টি ঘণ্টা কাটিয়ে নিউইয়র্ক পৌঁছলাম।জন গভীর রাতে আমাদেরকে নেবার জন্য এলো। আমি জানি নিউইয়র্ক সিটি নেভার স্লিপস। শান্তর জ্যাকসন হাইটস দেখার খুব ইচ্ছে। আমরা জ্যাকসন হাইটস-এ ডিনার করার জন্য রওয়ানা দিলাম। জ্যাকসন হাইটস-এ শাড়ি-গহনার দোকান বন্ধ হয়ে গেলেও অনেক রেস্টুরেন্ট সারারাত খোলা থাকে। আমরা একটি রেস্টুরেন্ট-এ গিয়ে অনেকদিন পর নান, কাবাব, চানাডাল দিয়ে ডিনার করলাম।
এবারের ট্যুর-টিতে নিজেরা কোনরকম ড্রাইভ না করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তাই ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রথমে নিউইয়র্ক বাসে যাওয়া ঠিক করলাম।শান্ত শুক্রবার ছুটি নিতে পারলনা কিন্তু একটু আগে অফিস থেকে বের হয়ে গেল। আমরা সন্ধ্যা ৬টার বাস ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় ওয়াশিংটন ডিসি-র চায়না টাউন পৌঁছলাম।
চায়না টাউনের বাস খুবই সস্তায় নিউইয়র্ক নিয়ে যায়।২০০৮-এ একবার গিয়েছিলাম। আসার সময়ে যে পরিমাণ কষ্ট করেছিলাম , তাতে ঠিক করেছিলাম যে আর কখনোই চায়না টাউনের বাস নয়। কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় তিনটি বছর কেটে গিয়েছে। বন্ধু-বান্ধব অনেকেই নিউইয়র্ক থেকে এসেছে, গিয়েছে। আমি তাদেরকে বাস-স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে এসেছি, আবার দিয়েও এসেছি। সবার কাছ থেকে প্রশংসাই শুনেছি। ভাবলাম তিন বছরে চায়না টাউনের বাস সার্ভিস নিশ্চয়ই উন্নতি হয়েছে। তাছাড়া লেবার ডে উইকেন্ড হওয়াতে অন্যান্য বাসের (মেগা, বোল্ট, গ্রে-হাউন্ড) টিকিট sold out। যাই হোক, আমরা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাস-স্ট্যান্ডে হাজির। ৪০ ডলার দিয়ে দুটি টিকেট কিনলাম। খুবই সস্তা। চায়না টাউনের বাসের নিজস্ব বাস-স্ট্যান্ড নেই।টিকিট যেখানে বিক্রি করে, তার সামনের রাস্তা থেকেই বাস ছাড়ে।আমাদের বাস ৬ টায় ছাড়বে। ঘড়ির কাটায় ৬ টা বেজে গেল, বাস আসছে না। ভাবলাম মিনিট দশেকের মধ্যে হয়তবা আসবে। সোয়া ছয়, সাড়ে ছয়, সাতটা বেজে গেল - কোন খবর নাই। রাস্তায় মানুষের ভিড়। কাউন্টারে আমি ও আরো দুজন গেলাম বাসের কথা জিজ্ঞেস করার জন্য। সেখানে যে মহিলা বসে আছে, তার ব্যবহার খুবই রুক্ষ। সে কোন কথাই বলতে চায় না। বার বার জিজ্ঞেস করার পর বলল, আরেকটু পর আসবে। বাসের এই সার্ভিসের জন্য তার মধ্যে লজ্জিত হওয়া বা ক্ষমা চাওয়া কোনটাই দেখা গেল না। অবশেষে ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে সাতটায় আরেকটি বাস ছাড়ার কথা ছিল, সেটার যাত্রীরাও একই লাইনে দাঁড়াল। সাড়ে সাতটায় একটি বাস নিউইয়র্ক থেকে এলো। আগত যাত্রীরা নেমে যাবার সাথে সাথেই সেই বাসে সবাই হুমড়ি খেয়ে উঠতে লাগল।আমি ও শান্ত বাসে উঠার যুদ্ধে হার মানলাম। বাস আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমেরিকার মত দেশে এটি কল্পনাই করা যায় না, কিন্তু এই ব্যাপারটি চোখের সামনে ঘটে গেল। উল্লেখ্য এই বাসের যাত্রীদের অধিকাংশই চাইনিজ, কোরিয়ান, ভিয়েতনামিজ, কালো। কাউন্টারের ঐ মহিলা এসে বলল যে আরেকটি বাস আসছে। আবার অপেক্ষার পালা। আরো একটি ঘণ্টা পার হওয়ার পর সাড়ে আটটায় আরেকটি বাস এলো। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, এবার যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে। বিনা যুদ্ধে অন্য-যাত্রীদেরকে উঠতে দিব না। যুদ্ধে জয়ী হলাম। বাসে উঠে শেষের দিকে আমরা কোনমতে দুটি আসন পেয়ে গেলাম।চীন বা ভারতের অর্থনীতির উত্থান নিয়ে অনেক বড় বড় কথা শুনেছি, শুনি। এমনকি এটাও শুনি যে, এরাই হয়তবা ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে শাসন করবে। আমার সন্দেহ - কোনকালে পারবে কিনা, পারলেও আগামী ২০০ বছরে সম্ভব কিনা? একটি জাতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে বড় হয়ে গেলেই বড় হয়ে যায় না। তাদের ভদ্রতাবোধ, সৌজন্যতা, নিয়ম-শৃঙ্খলাও শিখতে হয়। এই আমেরিকাতেই যখন এটা তাদের মধ্যে দেখতে পেলাম না, তাদের নিজেদের দেশে কী ভয়ানক অবস্থা তা সহজেই বোঝা যায়। বছর কয়েক আগে শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম।সেখানকার মানুষের মধ্যেও একই ব্যাপার দেখেছি। অবশ্য ব্যতিক্রম থাকতেও পারে। যাইহোক্, কোনরকমে বাসের মধ্যে ৫ টি ঘণ্টা কাটিয়ে নিউইয়র্ক পৌঁছলাম।জন গভীর রাতে আমাদেরকে নেবার জন্য এলো। আমি জানি নিউইয়র্ক সিটি নেভার স্লিপস। শান্তর জ্যাকসন হাইটস দেখার খুব ইচ্ছে। আমরা জ্যাকসন হাইটস-এ ডিনার করার জন্য রওয়ানা দিলাম। জ্যাকসন হাইটস-এ শাড়ি-গহনার দোকান বন্ধ হয়ে গেলেও অনেক রেস্টুরেন্ট সারারাত খোলা থাকে। আমরা একটি রেস্টুরেন্ট-এ গিয়ে অনেকদিন পর নান, কাবাব, চানাডাল দিয়ে ডিনার করলাম।
সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১১
আমরা ভোর সাড়ে ছয়টায় ডানকিন ডোনাটস (Dunkin Donuts) থেকে নাস্তা করে আমাদের বাস যেখান থেকে ছাড়ার কথা সেখানে হাজির হলাম। চমৎকার ব্যবস্থা ! বেশ কজন কর্মী কাজ করছে। আমাদের বাক্স-পেটরা ব্যাগেজ বিন-এ দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। আমাদের ট্যুর গাইডের নাম হল বেরি (Berry)। সে নিজেই তার নাম মনে রাখার জন্য স্ট্রবেরি, ব্লু-বেরি, ব্ল্যাক-বেরির কথা বলল। বেরি চমৎকার একজন লোক। আমাদের সাথে সত্যিই সে বন্ধুর মত মিশেছিল। আমাদের যাত্রার প্রথম স্থান নির্ধারিত হল কানেকটিকাটের ইয়েল (Yale) ইউনিভার্সিটি।
ছবিঃ ইয়েল ক্যাম্পাস
ঠিক কটায় গিয়ে ইয়েল পৌঁছলাম, খেয়াল নেই। তবে ইয়েল নিউইয়র্ক সিটি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ইয়েল-কে আমার নূতন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। আইভি লীগের (Ivy league) ৮টি স্কুলের মধ্যে ইয়েল একটি। শুধু তাই নয়, ‘ইয়েল স্কুল অফ ল’ আমেরিকার ল স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানেই আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, জর্জ বুশ, সেক্রেটারি অফ স্টেট হিলারি ক্লিনটন পড়াশুনা করেছেন। বিশাল জায়গা জুড়ে ইয়েল ইউনিভার্সিটি। ক্যাম্পাসে রয়েছে প্রচুর গাছপালা। এরই মধ্যে বিভিন্ন নামে সব হলগুলো। বাংলাদেশে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যখন ছিলাম, তখন ‘হল’ মানেই সেটা ছিল ছাত্রছাত্রীদের থাকার জায়গা। তাই কলম্বিয়াতে (Columbia) থাকাকালীন প্রথমেই যখন জানলাম আমার একটা ক্লাস হবে কেন্ট হল-এ, আরেকটি হবে হ্যামিলটন হল-এ তখন একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তাছাড়া হলগুলো বাইরে থেকে দেখতে আবাসিক বিল্ডিং-এর মতই মনে হয়। পরে আইওনা-তে (IONA) গিয়ে আর সমস্যা হয় নি।
ছবিঃ ইয়েলে আমি
ইয়েল-এ রয়েছে অনেক ভাস্কর্য। এটি প্রায় সব ইউনিভার্সিটিতেই থাকে। আমাদের ট্যুর গাইড একেকটি ভাস্কর্যের সামনে নিয়ে বর্ণনা করছে, আমরা শুনছি আর ছবি তুলছি। অনেককে দেখলাম বিখ্যাত কোন ভাস্কর্যের পায়ে হাত দিয়ে ছবি তুলছে, আমি এটির কারণ জানি না। কিছুক্ষণ পর বেরি আমদেরকে একা ছেড়ে দিল কিছু সময়ের জন্য।
ছবিঃ জন ও একজন ইয়েল স্টুডেন্ট
আমরা এখানে-সেখানে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। প্রায় ষাটোর্ধ চমৎকার এক ইয়েল প্রফেসরের সাথে দেখা হল। সে বাইক চালাচ্ছিল। সে ইয়েলে ৩০ বছর ধরে অধ্যাপনা করছে। ইয়েল সম্পর্কে সে অনেক ইতিহাস বলল। আরেকটি যেটি বলল, সেটি আসলেই আমার দেখার ইচ্ছে ছিল। এটি হচ্ছে ইয়েলের সুপার-এলিট সিক্রেট সোসাইটি - স্কাল এন্ড বোনস (Skull and Bones - The Yale Secret Society)-এর বিল্ডিং।
ছবিঃ স্কাল এন্ড বোনস বিল্ডিং
স্কাল এন্ড বোনস সম্পর্কে সামান্য বলে নেই। তথ্যমতে দেখা যায়, ১৮৩২-৩৩ সালে উইলিয়াম রাসেল নামে একজন সিনিয়র ইয়েল স্টুডেন্ট ফাই-বেটা-কাপ্পা (Phi-Beta-Kappa honor society) সিলেকশন প্রক্রিয়ায় বিরক্ত হয়ে জার্মান একটি স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের আমেরিকান চ্যাপ্টার হিসেবে ইউলোজিয়ান ক্লাব (Eulogian club) নামে একটি ক্লাব তৈরি করেন। এই ক্লাবটি গ্রীক দেবী ইউলোজিয়ার শ্রদ্ধায় তৈরি হয়। গ্রীক দেবী ইউলোজিয়া সারা বিশ্ব পরিচালনার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডে পরিকল্পনা তৈরি করত। Alphonso Taft ছিলেন এই ক্লাবের প্রথম মেম্বার, উল্লেখ্য Alphonso Taft-এর পুত্র William Howard Taft পরবর্তীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। স্কাল এন্ড বোন্স সোসাইটি আরো যেকারণে বিখ্যাত তা হল, বুশ পরিবারের তিন প্রজন্মই (জর্জ ডব্লিউ বুশ,ইয়েল ‘৬৮; জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশ, ইয়েল ‘৪৮ ; প্রেসকট বুশ, ইয়েল ‘১৭) এই সোসাইটির সদস্য ছিলেন এবং তারা লিজেন্ডারি বোনসম্যান (Bonesman) নামে পরিচিত। অনেক সময় এটাও বলা হয় যে, এখান থেকেই আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট খোঁজা হয়। আরো একটি মজার ব্যাপার আছে, ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন কেরী ও জর্জ বুশ দুজনেই বোনসম্যান ছিলেন এবং এই সোসাইটির মেম্বার হিসেবে তাদের একটি সিক্রেট আছে যা নাকি কেউই এখনও প্রকাশ করেননি। একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, এই বিল্ডিংটির কোন জানালা নাই - এটিকে উইন্ডো-লেস বিল্ডিং বলা হয়। আমরা এই স্কাল এন্ড বোন্স সোসাইটির সদস্য নই কিংবা কোনদিন হতেও পারব না, তবে বিল্ডিংটির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। এমনি করেই আমরা ইয়েল ইউনিভার্সিটির একটি অংশ দেখা শেষ করলাম কারণ এত কম সময়ে পুরোটা দেখা সম্ভব নয়।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর সময় হয়ে গেল। আমরা বাসে ফিরে গেলাম।
আমরা ভোর সাড়ে ছয়টায় ডানকিন ডোনাটস (Dunkin Donuts) থেকে নাস্তা করে আমাদের বাস যেখান থেকে ছাড়ার কথা সেখানে হাজির হলাম। চমৎকার ব্যবস্থা ! বেশ কজন কর্মী কাজ করছে। আমাদের বাক্স-পেটরা ব্যাগেজ বিন-এ দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। আমাদের ট্যুর গাইডের নাম হল বেরি (Berry)। সে নিজেই তার নাম মনে রাখার জন্য স্ট্রবেরি, ব্লু-বেরি, ব্ল্যাক-বেরির কথা বলল। বেরি চমৎকার একজন লোক। আমাদের সাথে সত্যিই সে বন্ধুর মত মিশেছিল। আমাদের যাত্রার প্রথম স্থান নির্ধারিত হল কানেকটিকাটের ইয়েল (Yale) ইউনিভার্সিটি।
ছবিঃ ইয়েল ক্যাম্পাস
ঠিক কটায় গিয়ে ইয়েল পৌঁছলাম, খেয়াল নেই। তবে ইয়েল নিউইয়র্ক সিটি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ইয়েল-কে আমার নূতন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। আইভি লীগের (Ivy league) ৮টি স্কুলের মধ্যে ইয়েল একটি। শুধু তাই নয়, ‘ইয়েল স্কুল অফ ল’ আমেরিকার ল স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানেই আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, জর্জ বুশ, সেক্রেটারি অফ স্টেট হিলারি ক্লিনটন পড়াশুনা করেছেন। বিশাল জায়গা জুড়ে ইয়েল ইউনিভার্সিটি। ক্যাম্পাসে রয়েছে প্রচুর গাছপালা। এরই মধ্যে বিভিন্ন নামে সব হলগুলো। বাংলাদেশে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যখন ছিলাম, তখন ‘হল’ মানেই সেটা ছিল ছাত্রছাত্রীদের থাকার জায়গা। তাই কলম্বিয়াতে (Columbia) থাকাকালীন প্রথমেই যখন জানলাম আমার একটা ক্লাস হবে কেন্ট হল-এ, আরেকটি হবে হ্যামিলটন হল-এ তখন একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তাছাড়া হলগুলো বাইরে থেকে দেখতে আবাসিক বিল্ডিং-এর মতই মনে হয়। পরে আইওনা-তে (IONA) গিয়ে আর সমস্যা হয় নি।
ছবিঃ ইয়েলে আমি
ইয়েল-এ রয়েছে অনেক ভাস্কর্য। এটি প্রায় সব ইউনিভার্সিটিতেই থাকে। আমাদের ট্যুর গাইড একেকটি ভাস্কর্যের সামনে নিয়ে বর্ণনা করছে, আমরা শুনছি আর ছবি তুলছি। অনেককে দেখলাম বিখ্যাত কোন ভাস্কর্যের পায়ে হাত দিয়ে ছবি তুলছে, আমি এটির কারণ জানি না। কিছুক্ষণ পর বেরি আমদেরকে একা ছেড়ে দিল কিছু সময়ের জন্য।
ছবিঃ জন ও একজন ইয়েল স্টুডেন্ট
আমরা এখানে-সেখানে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। প্রায় ষাটোর্ধ চমৎকার এক ইয়েল প্রফেসরের সাথে দেখা হল। সে বাইক চালাচ্ছিল। সে ইয়েলে ৩০ বছর ধরে অধ্যাপনা করছে। ইয়েল সম্পর্কে সে অনেক ইতিহাস বলল। আরেকটি যেটি বলল, সেটি আসলেই আমার দেখার ইচ্ছে ছিল। এটি হচ্ছে ইয়েলের সুপার-এলিট সিক্রেট সোসাইটি - স্কাল এন্ড বোনস (Skull and Bones - The Yale Secret Society)-এর বিল্ডিং।
ছবিঃ স্কাল এন্ড বোনস বিল্ডিং
স্কাল এন্ড বোনস সম্পর্কে সামান্য বলে নেই। তথ্যমতে দেখা যায়, ১৮৩২-৩৩ সালে উইলিয়াম রাসেল নামে একজন সিনিয়র ইয়েল স্টুডেন্ট ফাই-বেটা-কাপ্পা (Phi-Beta-Kappa honor society) সিলেকশন প্রক্রিয়ায় বিরক্ত হয়ে জার্মান একটি স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের আমেরিকান চ্যাপ্টার হিসেবে ইউলোজিয়ান ক্লাব (Eulogian club) নামে একটি ক্লাব তৈরি করেন। এই ক্লাবটি গ্রীক দেবী ইউলোজিয়ার শ্রদ্ধায় তৈরি হয়। গ্রীক দেবী ইউলোজিয়া সারা বিশ্ব পরিচালনার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডে পরিকল্পনা তৈরি করত। Alphonso Taft ছিলেন এই ক্লাবের প্রথম মেম্বার, উল্লেখ্য Alphonso Taft-এর পুত্র William Howard Taft পরবর্তীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। স্কাল এন্ড বোন্স সোসাইটি আরো যেকারণে বিখ্যাত তা হল, বুশ পরিবারের তিন প্রজন্মই (জর্জ ডব্লিউ বুশ,ইয়েল ‘৬৮; জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশ, ইয়েল ‘৪৮ ; প্রেসকট বুশ, ইয়েল ‘১৭) এই সোসাইটির সদস্য ছিলেন এবং তারা লিজেন্ডারি বোনসম্যান (Bonesman) নামে পরিচিত। অনেক সময় এটাও বলা হয় যে, এখান থেকেই আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট খোঁজা হয়। আরো একটি মজার ব্যাপার আছে, ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন কেরী ও জর্জ বুশ দুজনেই বোনসম্যান ছিলেন এবং এই সোসাইটির মেম্বার হিসেবে তাদের একটি সিক্রেট আছে যা নাকি কেউই এখনও প্রকাশ করেননি। একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, এই বিল্ডিংটির কোন জানালা নাই - এটিকে উইন্ডো-লেস বিল্ডিং বলা হয়। আমরা এই স্কাল এন্ড বোন্স সোসাইটির সদস্য নই কিংবা কোনদিন হতেও পারব না, তবে বিল্ডিংটির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। এমনি করেই আমরা ইয়েল ইউনিভার্সিটির একটি অংশ দেখা শেষ করলাম কারণ এত কম সময়ে পুরোটা দেখা সম্ভব নয়।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর সময় হয়ে গেল। আমরা বাসে ফিরে গেলাম।
ইয়েল থেকে আমরা বাসে ফিরে এলাম। বাসে ফেরার সাথে সাথেই আমাদের ট্যুরগাইড বেরি আমাদেরকে একটা সুখবর দিল। আমাদের রাতে থাকার কথা ছিল ইকোনমি হোটেল কমফোর্ট ইনন-এ (Comfort Inn)। বেরি বলল যে, আমাদের ট্যুর সার্ভিস আপগ্রেড করে স্টারউড হোটেল ব্র্যান্ড শেরাটনে-থাকার (Starwood Hotel Brand-Sheraton) ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুনে মনটা ভালো হয়ে গেল! সারাদিনের হাঁটাহাঁটি শেষে ভালো একটা ঘুম দেওয়া যাবে। এরপর আমাদের যাওয়ার কথা ছিল কানেকটিকাটের Mystic Aquarium। বেরি আমাদের দুটি পছন্দ দিল - একটি হল Mystic Aquarium ও অপরটি হল Submarine Force Museum।
ছবিঃ ইউএসএস নট্যালাস এস এস এন ৫৭১ (USS NAUTILUS SSN 571)
ছবিঃ ইউএসএস নট্যালাস এস এস এন ৫৭১ (USS NAUTILUS SSN 571)
যেকোনো একটিতে যাওয়া যাবে কিন্তু দুটি নয়। যারা একুয়ারিয়ামে যেতে চাইবে তাদেরকে একুয়ারিয়ামে নামিয়ে দিয়ে বাকীদেরকে সাবমেরিন মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হবে। ফেরার পথে তাদেরকে একুয়ারিয়াম থেকে তোলা হবে। বেরির কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, এ একুয়ারিয়ামটি তেমন বড় নয়। যারা ইতিমধ্যে নিউইয়র্কের কনি আইল্যান্ড-এর একুয়ারিয়াম দেখেছে সে তুলনায় এটি ছোট। আমরা কনি আইল্যান্ড-এর চেয়েও আকর্ষণীয় বাল্টিমোরের একুয়ারিয়ামও দেখেছি, তাই সাবমেরিন মিউজিয়ামে যাওয়ার পক্ষে হাত তুললাম। ইতিমধ্যে লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছে। আমাদেরকে পাণ্ডা এক্সপ্রেস-এ নিয়ে যাওয়া হল। এটি যদিও মাত্র ১০ ডলার বুফে, তবুও আমাদের কারোরই পছন্দ নয়। কিন্তু কিছুই করার নেই, ট্যুর-এর সাথে থাকলে কিছু কিছু ব্যাপার মেনে নিতেই হয়। সেখানে আমরা আমাদের খাবার টেবিলে আমাদেরই সহযাত্রী এক মা ও মেয়েকে আবিষ্কার করলাম। আশ্চর্য যে, তারা কলকাতার বাঙ্গালী! তাদের সাথে পরিচয় হল। আমরা বসেছিলাম বাসের সর্বপিছনে যে তিনটি সীট আছে সেখানে। আমরা এই সীটটি নিয়েছিলাম এই কারণে যে এটিতেই কেবলমাত্র আমরা তিনজন একসাথে বসে যেতে পারব। আরো বেশী আশ্চর্য হলাম যে, মাধুরী ও তার মা আমাদের ঠিক আগে ডানদিকের সীট-টিতে বসেছে। আমরা খেয়ালও করিনি। আমরা তো সমানে বিভিন্ন রকমের কথা নিজেদের মধ্যে বাংলায় চালাচ্ছিলাম। এবার কিছুটা অস্বস্তিতেই পড়লাম কারণ আমাদের আলোচনায় অনেক আপত্তিকর বিষয়ও ছিল। এদেরকে খেয়াল না করার আরো একটি কারণ ছিল। আমাদের ঠিক আগের আমাদের সীট বরাবর বাম দিকের সিট-টিতে আরো দুই ভারতীয় সুন্দরী ছিল। আমরা ওদের নিয়েই মোটামুটি ব্যস্ত ছিলাম। যাই হোক্, মাধুরী ও তার মা চমৎকার মানুষ। আমাদের সাথে মাধুরী বন্ধুর মত মিশেছিল।
কিছু ভ্রমণকারী সহ ভারতীয় সুন্দরীর দলটি একুয়ারিয়ামে নেমে গেল। আমরা সাবমেরিনের দিকে যাত্রা করলাম। মাধুরী ও তার মা অবশ্য আমাদের সাথেই ছিল।
সাবমেরিন ফোর্স মিউজিয়ামে (Submarine Force Museum)
ছবিঃ ইউএসএস নট্যালাস এস এস এন ৫৭১ (USS NAUTILUS SSN 571)
মুভিতে সাবমেরিন অনেক দেখেছি এবং ভাবতাম যে, যদি কোনদিন সাবমেরিনের ভেতরটা ঘুরে দেখা যেত। কাকতালীয়ভাবে আমি এখন একটি সাবমেরিনের সামনে। যদিও এটা চলছে না, তারপরেও চোখের সামনে জলজ্যান্ত একটি সাবমেরিন! বছর কয়েক আগেও হ্যারিসন ফোর্ডের K-19 মুভিটা দেখেছি। আমার সামনে যে সাবমেরিনটি, সেটিতে আমি এখনই উঠবো - এটি হল ইউএসএস নট্যালাস এস এস এন ৫৭১ (USS NAUTILUS SSN 571)। এটি আমেরিকার এবং বিশ্বের সর্বপ্রথম নিউক্লিয়ার পাওয়ারড (Nuclear Powered) সাবমেরিন এবং ১৯৫১ সালে কংগ্রেস এটি তৈরির অনুমোদন দিয়েছিল। ফার্স্ট লেডি মিসেস আইজেনহাওয়ারের উপস্থিতিতে নট্যালাস সর্বপ্রথম টেমস (Thames) নদীতে পদার্পণ করে ১৯৫৪ সালের ২১শে জানুয়ারি। নট্যালাসকে প্রথম সমুদ্রে নামানো হয় ১৯৫৫ সালের ১৭ই জানুয়ারি আর ঐতিহাসিক সংবাদটি ছিল এরকম, “Underway on nuclear power”। তারপর থেকে ঐতিহাসিক নট্যালাসের যাত্রা আর থেমে থাকেনি। নট্যালাস পানির নীচে ৭০০ ফুট পর্যন্ত গভীরে যেতে পারত। ৩০০০০০ মাইলেরও বেশী পথ অতিক্রম শেষে ১৯৮০ সালের মার্চ মাসের ৩ তারিখে নট্যালাস তার ২৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের যাত্রা পরিসমাপ্তি করে। যাত্রা শেষ করলেও নট্যালাসকে সর্বসাধারণের জন্য সাবমেরিন ফোর্স যাদুঘরে উন্মুক্ত করা হয় ১৯৮৬ সালের ১১ই এপ্রিল থেকে। আমরা নট্যালাসে পা রাখলাম। চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখছি। কেমন যেন যুদ্ধে যাওয়ার একটা অনুভূতি হচ্ছে। মুভিতে সাবমেরিনের যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন কাজ দেখিনি। সাবমেরিন থেকে টর্পেডো মারা হচ্ছে কিংবা অন্য সাবমেরিনের টর্পেডোর আঘাতে সাবমেরিন ডুবে যাচ্ছে - এসবই তো মুভিতে দেখেছি। এরপর সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামার পালা। একজন নেভী অফিসার আমাদেরকে চেক করে একটি করে হেডফোন দিয়ে দিল। হেডফোন নট্যালাসের ভেতরটা ঘুরে দেখার সময় বিভিন্ন বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করবে। আমরা লোহার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলাম। সিঁড়িগুলি ছিল খুবই ছোট। সাবমেরিনের ভেতরে চলাচলের রাস্তাও খুবই সরু। একটি প্রকোষ্ঠ থেকে আরেকটি প্রকোষ্ঠে যাওয়ার জন্য ডিম্বাকৃতি লোহার দরজা। আমার মনে হয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য এগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে বন্ধ করে দিলে সামান্য ফাঁকা না থাকে যা দিয়ে পানি প্রবেশ করতে পারবে।
ছবিঃ কন্ট্রোল রুম
আমরা প্রথমেই কন্ট্রোল রুমে গেলাম। কন্ট্রোল রুমটি সাধারণত সাবমেরিনের একটু বড় হয়ে থাকে। এটিকে সাবমেরিনের মস্তিষ্কের সাথে তুলনা করা হয়। এখান থেকেই সাবমেরিন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জিপিএস-এর মাধ্যমে নেভিগেশন এখানেই গণনা করা হয়। এখানেই আছে প্লটিং টেবিল - যে টেবিলে থাকে বিশাল মানচিত্র। সাবমেরিনের বেসিক ব্যাপারটা বোঝা গেলেও কন্ট্রোল-রুমের জটিল যন্ত্রপাতি আমার বোঝা সম্ভব নয়,তাই অন্য রুমে চলে গেলাম।
ছবিঃপেরিস্কোপ রুম
এবার সাবমেরিনের আকর্ষণীয় পেরিস্কোপ রুম। এটি ঠিক অন্য প্রকোষ্ঠ নয়, কন্ট্রোল রুমের প্লটিং টেবিলটির পরেই পেরিস্কোপ রুম। পেরিস্কোপ হল সেই টিউব যার সাথে লাগানো থাকে অনেকগুলি প্রিজম এবং যা দিয়ে পানির নীচে সাবমেরিনের ভেতর থেকে বাইরের সমস্ত কিছু দেখা যায়। এটিকে তাই বলা হয় উইন্ডোজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড। পানির নীচ থেকে পেরিস্কোপে চোখ লাগিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়তবা হবে না কিন্তু চোখের সামনে পেরিস্কোপ - এটিই বা কম কীসে? তারপরে আমরা ওয়ার্ডরুমে গেলাম। এখানে সাবমেরিনের সকল ক্রু খাওয়া-দাওয়া করত। বিশাল একটি ডাইনিং টেবিল আছে যেটিতে সর্বমোট ৮ টি চেয়ার লাগানো আছে। এছাড়াও এই রুমটিতে রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোওয়েভ, কফি বানানোর সুব্যবস্থাসহ অনেক কিছুই আছে। আমরা তারপর ক্রু মেম্বারদের শোয়ার ব্যবস্থা, স্নানাগার-শৌচাগার, রান্নাঘর দেখলাম। রান্নাঘরে একজন শেফ-এর ডামি দেখে বোঝা গেল যে, সাবমেরিনে সবার রান্নার জন্য একজন শেফ-ও থাকেন।
ছবিঃ রান্নাঘর
আমরা টর্পেডো রুমটিও দেখলাম যেখান থেকে টর্পেডো ছোঁড়া হয়। এভাবে পুরো নট্যালাস দেখা শেষে নট্যালাস থেকে বেরিয়ে এলাম। নট্যালাস থেকে বেরিয়ে আসার পর আমরা এখানকার যাদুঘরটিতে ঢুকলাম। সেখানে আছে বিভিন্ন রকমের ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, সাবমেরিনের ভেতরকার বিভিন্ন রুমের ডামি, বিভিন্ন রকমের অস্ত্রশস্ত্র। সাবমেরিন মিউজিয়াম ঘুরে এসে আমাদের পরবর্তী যাত্রা নির্ধারণ হল রোড আইল্যান্ড-এর বৃকারস হাউজ।
দ্যা বৃকারস (The Breakers)
ছবিঃবৃকারস (সামনে থেকে)
আমেরিকার বিখ্যাত পরিবার ভ্যান্ডারবিল্ট পরিবার (Vanderbilt Famliy)। এই পরিবার বিভিন্ন কারণে বিখ্যাত, যেমন - এ পরিবারের কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্টের (Cornelius Vanderbilt) হাত দিয়েই আমেরিকার রেইলরোডের (America’s Railroads) নির্মাণ কাজ শুরু। ন্যাশভিলে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে ভ্যান্ডারবিল্ট ১ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য এই ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মাইক্রো-ক্রেডিটের ফাদার আমাদের মুহম্মদ ইউনুস তার পিএইচডি করেছেন। এই পরিবারের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। অনেকগুলো ম্যানশনের মধ্যে রোড আইল্যান্ড-এর নিউপোর্টের এই বৃকারস-ও সামার হোম হিসেবে কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্টেরই করা।বৃকারস-এর ডিজাইন করেছেন বিখ্যাত আর্কিটেক্ট রিচার্ড মরিস হান্ট। বৃকারস-এ ঢোকার সময় প্রথমে যে ধাক্কাটা খেলাম সেটা হল ভেতরে ইন্টেরিয়রের কোন ছবি তোলা যাবে না। সমগ্র এলাকাটি ৬৫০০০ বর্গফুটের ও ভেতরে সর্বমোট ৭০ টি কামরা আছে। এটি করতে ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৫ অর্থাৎ মোট ২ বছর সময় লেগেছে। তখনকার সময়েই খরচ হয়েছে ১২ মিলিয়ন ডলার যা এখনকার হিসেবে প্রায় ৩১০ মিলিয়নের সমান। বৃকারসের ভেতরে ঢোকার সময়েও আমদের হাতে হেডফোন দেওয়া হলো। প্রতিটা রুমে যাওয়ার সাথে সাথে হেডফোনে বলা হয় রুমটি কী, কী করা হোত ইত্যাদি। প্রথম ফ্লোরটিতে লোকজনের বসার বিশাল জায়গা ছাড়াও আছে লাইব্রেরী, সংগীত কামরা, বিলিয়ার্ড, ডাইনিং, নাস্তা, প্যান্ট্রি, রান্নাঘর ইত্যাদিসহ আরো অনেক কামরা আছে। আছে কারুকার্য করা আসবাবপত্র। বিশাল রান্নাঘরটি দেখার মত। দ্বিতীয় তলায় মিস্টার আর মিসেস ভ্যান্ডারবিল্টের কামরা, অতিথি কামরা ছাড়াও আরো কিছু কামরা আছে অন্যান্যদের জন্য। তৃতীয় তলাটি দুই ভাগে বিভক্ত এবং এখানে আছে শেফ, বাটলার ও অন্যান্য যারা কাজ করত তাদের জন্য কামরা। এছাড়াও আছে এটিক ফ্লোর(Attic Floor), বেইজমেন্ট (Basement)। বিশাল এই বাড়িটির কামরাগুলো গণনা করে দেখা যায় না। আমাদের অনেক কামরাতেই যাওয়া হয়নি।
ছবিঃবৃকারস
আমার শুধু একটি কথাই মনে হচ্ছিল- ঢাকার নবাবপুরের আহসান মঞ্জিলে আমি গিয়েছি। আমাদের আহসান মঞ্জিলটিও কিন্তু কম সুন্দর নয়। আমাদের নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ-এর অবদানও কিন্তু অনস্বীকার্য। তিনি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আহসানুল্লাহ স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং (বর্তমানে বুয়েট) এর একজন ফাউন্ডার মেম্বার। তার নামে তো কোন প্রতিষ্ঠান দেখি না অথচ আজকাল অবদান না থাকা সত্ত্বেও সবকিছ্বর নামকরণের নগ্ন প্রতিযোগিতা চলছে। বৃকার হাউজের যে ব্যাপারটি আমার কাছে চমৎকার লেগেছে সেটি হল বারান্দাটি। বারান্দা থেকে আটলান্টিক সমুদ্র দেখা যায়। সেখানে ছবি তোলার অনুমতি ছিল।
ছবিঃ বৃকারস (পেছনে আটলান্টিকের দিকে)
তারপর আমরা বৃকারস হাউজ থেকে বের হয়ে, বাড়িটির পেছনে বিশাল উন্মুক্ত জায়গায় গেলাম। বৃকারস হাউজটি আটলান্টিকের সামনে করা। সেই উন্মুক্ত জায়গা দিয়ে হেঁটে আটলান্টিকের কাছাকাছি যাওয়া যায়। এখানটার বাগানটিও অসম্ভব সুন্দর। আছে অনেক দুষ্প্রাপ্য বিশাল গাছ।
ছবিঃবৃকারস হাউজে একটি বৃক্ষ
চারিদিকে আছে জাপানিজ Yew, চাইনিজ Juniper আর hemlock। এছাড়া পুরো বাগানটি রডোডেনড্রন, লরেল আর ডগউড দিয়ে ঘেরা। আছে আরো চমৎকার কিছু ভাস্কর্য। আমরা বৃকারস দেখা শেষে বাসে ফিরে এলাম মে ফ্লাওয়ার টু দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
মে ফ্লাওয়ার টু (Mayflower II)
ছবিঃ মে ফ্লাওয়ার ২
কিছু ভ্রমণকারী সহ ভারতীয় সুন্দরীর দলটি একুয়ারিয়ামে নেমে গেল। আমরা সাবমেরিনের দিকে যাত্রা করলাম। মাধুরী ও তার মা অবশ্য আমাদের সাথেই ছিল।
সাবমেরিন ফোর্স মিউজিয়ামে (Submarine Force Museum)
ছবিঃ ইউএসএস নট্যালাস এস এস এন ৫৭১ (USS NAUTILUS SSN 571)
মুভিতে সাবমেরিন অনেক দেখেছি এবং ভাবতাম যে, যদি কোনদিন সাবমেরিনের ভেতরটা ঘুরে দেখা যেত। কাকতালীয়ভাবে আমি এখন একটি সাবমেরিনের সামনে। যদিও এটা চলছে না, তারপরেও চোখের সামনে জলজ্যান্ত একটি সাবমেরিন! বছর কয়েক আগেও হ্যারিসন ফোর্ডের K-19 মুভিটা দেখেছি। আমার সামনে যে সাবমেরিনটি, সেটিতে আমি এখনই উঠবো - এটি হল ইউএসএস নট্যালাস এস এস এন ৫৭১ (USS NAUTILUS SSN 571)। এটি আমেরিকার এবং বিশ্বের সর্বপ্রথম নিউক্লিয়ার পাওয়ারড (Nuclear Powered) সাবমেরিন এবং ১৯৫১ সালে কংগ্রেস এটি তৈরির অনুমোদন দিয়েছিল। ফার্স্ট লেডি মিসেস আইজেনহাওয়ারের উপস্থিতিতে নট্যালাস সর্বপ্রথম টেমস (Thames) নদীতে পদার্পণ করে ১৯৫৪ সালের ২১শে জানুয়ারি। নট্যালাসকে প্রথম সমুদ্রে নামানো হয় ১৯৫৫ সালের ১৭ই জানুয়ারি আর ঐতিহাসিক সংবাদটি ছিল এরকম, “Underway on nuclear power”। তারপর থেকে ঐতিহাসিক নট্যালাসের যাত্রা আর থেমে থাকেনি। নট্যালাস পানির নীচে ৭০০ ফুট পর্যন্ত গভীরে যেতে পারত। ৩০০০০০ মাইলেরও বেশী পথ অতিক্রম শেষে ১৯৮০ সালের মার্চ মাসের ৩ তারিখে নট্যালাস তার ২৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের যাত্রা পরিসমাপ্তি করে। যাত্রা শেষ করলেও নট্যালাসকে সর্বসাধারণের জন্য সাবমেরিন ফোর্স যাদুঘরে উন্মুক্ত করা হয় ১৯৮৬ সালের ১১ই এপ্রিল থেকে। আমরা নট্যালাসে পা রাখলাম। চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখছি। কেমন যেন যুদ্ধে যাওয়ার একটা অনুভূতি হচ্ছে। মুভিতে সাবমেরিনের যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন কাজ দেখিনি। সাবমেরিন থেকে টর্পেডো মারা হচ্ছে কিংবা অন্য সাবমেরিনের টর্পেডোর আঘাতে সাবমেরিন ডুবে যাচ্ছে - এসবই তো মুভিতে দেখেছি। এরপর সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামার পালা। একজন নেভী অফিসার আমাদেরকে চেক করে একটি করে হেডফোন দিয়ে দিল। হেডফোন নট্যালাসের ভেতরটা ঘুরে দেখার সময় বিভিন্ন বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করবে। আমরা লোহার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলাম। সিঁড়িগুলি ছিল খুবই ছোট। সাবমেরিনের ভেতরে চলাচলের রাস্তাও খুবই সরু। একটি প্রকোষ্ঠ থেকে আরেকটি প্রকোষ্ঠে যাওয়ার জন্য ডিম্বাকৃতি লোহার দরজা। আমার মনে হয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য এগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে বন্ধ করে দিলে সামান্য ফাঁকা না থাকে যা দিয়ে পানি প্রবেশ করতে পারবে।
ছবিঃ কন্ট্রোল রুম
আমরা প্রথমেই কন্ট্রোল রুমে গেলাম। কন্ট্রোল রুমটি সাধারণত সাবমেরিনের একটু বড় হয়ে থাকে। এটিকে সাবমেরিনের মস্তিষ্কের সাথে তুলনা করা হয়। এখান থেকেই সাবমেরিন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জিপিএস-এর মাধ্যমে নেভিগেশন এখানেই গণনা করা হয়। এখানেই আছে প্লটিং টেবিল - যে টেবিলে থাকে বিশাল মানচিত্র। সাবমেরিনের বেসিক ব্যাপারটা বোঝা গেলেও কন্ট্রোল-রুমের জটিল যন্ত্রপাতি আমার বোঝা সম্ভব নয়,তাই অন্য রুমে চলে গেলাম।
ছবিঃপেরিস্কোপ রুম
এবার সাবমেরিনের আকর্ষণীয় পেরিস্কোপ রুম। এটি ঠিক অন্য প্রকোষ্ঠ নয়, কন্ট্রোল রুমের প্লটিং টেবিলটির পরেই পেরিস্কোপ রুম। পেরিস্কোপ হল সেই টিউব যার সাথে লাগানো থাকে অনেকগুলি প্রিজম এবং যা দিয়ে পানির নীচে সাবমেরিনের ভেতর থেকে বাইরের সমস্ত কিছু দেখা যায়। এটিকে তাই বলা হয় উইন্ডোজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড। পানির নীচ থেকে পেরিস্কোপে চোখ লাগিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়তবা হবে না কিন্তু চোখের সামনে পেরিস্কোপ - এটিই বা কম কীসে? তারপরে আমরা ওয়ার্ডরুমে গেলাম। এখানে সাবমেরিনের সকল ক্রু খাওয়া-দাওয়া করত। বিশাল একটি ডাইনিং টেবিল আছে যেটিতে সর্বমোট ৮ টি চেয়ার লাগানো আছে। এছাড়াও এই রুমটিতে রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোওয়েভ, কফি বানানোর সুব্যবস্থাসহ অনেক কিছুই আছে। আমরা তারপর ক্রু মেম্বারদের শোয়ার ব্যবস্থা, স্নানাগার-শৌচাগার, রান্নাঘর দেখলাম। রান্নাঘরে একজন শেফ-এর ডামি দেখে বোঝা গেল যে, সাবমেরিনে সবার রান্নার জন্য একজন শেফ-ও থাকেন।
ছবিঃ রান্নাঘর
আমরা টর্পেডো রুমটিও দেখলাম যেখান থেকে টর্পেডো ছোঁড়া হয়। এভাবে পুরো নট্যালাস দেখা শেষে নট্যালাস থেকে বেরিয়ে এলাম। নট্যালাস থেকে বেরিয়ে আসার পর আমরা এখানকার যাদুঘরটিতে ঢুকলাম। সেখানে আছে বিভিন্ন রকমের ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, সাবমেরিনের ভেতরকার বিভিন্ন রুমের ডামি, বিভিন্ন রকমের অস্ত্রশস্ত্র। সাবমেরিন মিউজিয়াম ঘুরে এসে আমাদের পরবর্তী যাত্রা নির্ধারণ হল রোড আইল্যান্ড-এর বৃকারস হাউজ।
দ্যা বৃকারস (The Breakers)
ছবিঃবৃকারস (সামনে থেকে)
আমেরিকার বিখ্যাত পরিবার ভ্যান্ডারবিল্ট পরিবার (Vanderbilt Famliy)। এই পরিবার বিভিন্ন কারণে বিখ্যাত, যেমন - এ পরিবারের কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্টের (Cornelius Vanderbilt) হাত দিয়েই আমেরিকার রেইলরোডের (America’s Railroads) নির্মাণ কাজ শুরু। ন্যাশভিলে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে ভ্যান্ডারবিল্ট ১ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য এই ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মাইক্রো-ক্রেডিটের ফাদার আমাদের মুহম্মদ ইউনুস তার পিএইচডি করেছেন। এই পরিবারের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। অনেকগুলো ম্যানশনের মধ্যে রোড আইল্যান্ড-এর নিউপোর্টের এই বৃকারস-ও সামার হোম হিসেবে কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্টেরই করা।বৃকারস-এর ডিজাইন করেছেন বিখ্যাত আর্কিটেক্ট রিচার্ড মরিস হান্ট। বৃকারস-এ ঢোকার সময় প্রথমে যে ধাক্কাটা খেলাম সেটা হল ভেতরে ইন্টেরিয়রের কোন ছবি তোলা যাবে না। সমগ্র এলাকাটি ৬৫০০০ বর্গফুটের ও ভেতরে সর্বমোট ৭০ টি কামরা আছে। এটি করতে ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৫ অর্থাৎ মোট ২ বছর সময় লেগেছে। তখনকার সময়েই খরচ হয়েছে ১২ মিলিয়ন ডলার যা এখনকার হিসেবে প্রায় ৩১০ মিলিয়নের সমান। বৃকারসের ভেতরে ঢোকার সময়েও আমদের হাতে হেডফোন দেওয়া হলো। প্রতিটা রুমে যাওয়ার সাথে সাথে হেডফোনে বলা হয় রুমটি কী, কী করা হোত ইত্যাদি। প্রথম ফ্লোরটিতে লোকজনের বসার বিশাল জায়গা ছাড়াও আছে লাইব্রেরী, সংগীত কামরা, বিলিয়ার্ড, ডাইনিং, নাস্তা, প্যান্ট্রি, রান্নাঘর ইত্যাদিসহ আরো অনেক কামরা আছে। আছে কারুকার্য করা আসবাবপত্র। বিশাল রান্নাঘরটি দেখার মত। দ্বিতীয় তলায় মিস্টার আর মিসেস ভ্যান্ডারবিল্টের কামরা, অতিথি কামরা ছাড়াও আরো কিছু কামরা আছে অন্যান্যদের জন্য। তৃতীয় তলাটি দুই ভাগে বিভক্ত এবং এখানে আছে শেফ, বাটলার ও অন্যান্য যারা কাজ করত তাদের জন্য কামরা। এছাড়াও আছে এটিক ফ্লোর(Attic Floor), বেইজমেন্ট (Basement)। বিশাল এই বাড়িটির কামরাগুলো গণনা করে দেখা যায় না। আমাদের অনেক কামরাতেই যাওয়া হয়নি।
ছবিঃবৃকারস
আমার শুধু একটি কথাই মনে হচ্ছিল- ঢাকার নবাবপুরের আহসান মঞ্জিলে আমি গিয়েছি। আমাদের আহসান মঞ্জিলটিও কিন্তু কম সুন্দর নয়। আমাদের নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ-এর অবদানও কিন্তু অনস্বীকার্য। তিনি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আহসানুল্লাহ স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং (বর্তমানে বুয়েট) এর একজন ফাউন্ডার মেম্বার। তার নামে তো কোন প্রতিষ্ঠান দেখি না অথচ আজকাল অবদান না থাকা সত্ত্বেও সবকিছ্বর নামকরণের নগ্ন প্রতিযোগিতা চলছে। বৃকার হাউজের যে ব্যাপারটি আমার কাছে চমৎকার লেগেছে সেটি হল বারান্দাটি। বারান্দা থেকে আটলান্টিক সমুদ্র দেখা যায়। সেখানে ছবি তোলার অনুমতি ছিল।
ছবিঃ বৃকারস (পেছনে আটলান্টিকের দিকে)
তারপর আমরা বৃকারস হাউজ থেকে বের হয়ে, বাড়িটির পেছনে বিশাল উন্মুক্ত জায়গায় গেলাম। বৃকারস হাউজটি আটলান্টিকের সামনে করা। সেই উন্মুক্ত জায়গা দিয়ে হেঁটে আটলান্টিকের কাছাকাছি যাওয়া যায়। এখানটার বাগানটিও অসম্ভব সুন্দর। আছে অনেক দুষ্প্রাপ্য বিশাল গাছ।
ছবিঃবৃকারস হাউজে একটি বৃক্ষ
চারিদিকে আছে জাপানিজ Yew, চাইনিজ Juniper আর hemlock। এছাড়া পুরো বাগানটি রডোডেনড্রন, লরেল আর ডগউড দিয়ে ঘেরা। আছে আরো চমৎকার কিছু ভাস্কর্য। আমরা বৃকারস দেখা শেষে বাসে ফিরে এলাম মে ফ্লাওয়ার টু দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
মে ফ্লাওয়ার টু (Mayflower II)
ছবিঃ মে ফ্লাওয়ার ২
আমরা এবার ম্যাসেচুসেটস-এর প্লাইমাউথে মে ফ্লাওয়ার ২ জাহাজটি দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। এটি ১৬২০ সালে নির্মিত অরিজিনাল মে ফ্লাওয়ারের হুবহু অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে। এটি ১৯৫৭ সালে ইংল্যান্ড থেকে রওয়ানা দিয়ে আটলান্টিক পার হয়ে আমেরিকায় আসে। আমাদের ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন ছিল না কারণ আমরা যখন মে ফ্লাওয়ার ২ দেখতে গিয়েছি তখন সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়ে গিয়েছে। ভিজিটর সেন্টার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা আর জাহাজে উঠে দেখতে পেলাম না। বাইরে থেকে জায়গাটা ঘুরে কিছু ছবি তুলে ফিরে আসতে হল।
তারপর সরাসরি বোস্টন সিটিতে চলে এলাম। বাইরে ডিনার শেষে রাতের আলোকোজ্জ্বল বোস্টন সিটি ঘুরে দেখলাম। তাছাড়া সেটা ছিল শনিবারের রাত। জমজমাট সিটিতে বার-ক্লাব উন্মুক্ত। চতুর্দিকে ধারালো গর্জিয়াস ললনাদের আনাগোনা। আমরা একটু রাত করেই হোটেলে ফিরলাম। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে গভীর নিদ্রায় চলে গেলাম।
তারপর সরাসরি বোস্টন সিটিতে চলে এলাম। বাইরে ডিনার শেষে রাতের আলোকোজ্জ্বল বোস্টন সিটি ঘুরে দেখলাম। তাছাড়া সেটা ছিল শনিবারের রাত। জমজমাট সিটিতে বার-ক্লাব উন্মুক্ত। চতুর্দিকে ধারালো গর্জিয়াস ললনাদের আনাগোনা। আমরা একটু রাত করেই হোটেলে ফিরলাম। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে গভীর নিদ্রায় চলে গেলাম।
ঘড়ির এলার্মে শেরাটনের নরম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হল। তবে আমরাই ছিলাম সর্বশেষ। হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি, আমাদের ট্যুর গাইড বেরি ও অন্যান্যরা আমাদের জন্য বাসে অপেক্ষা করছে। বাসে উঠার সময়ে বেরি চোখ ঈশারা করল, এর অর্থ হল- কাল রাতে আমি তোমাদের হেনিকেন হাতে দেখেছি (রাতে সত্যিই হোটেলে ফেরার সময়ে বেরির সাথে দেখা হয়েছিল) ! আমাদের যাত্রা সর্বপ্রথমে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ও সকালের নাস্তা সেখানেই হবে। বাস ছেড়ে দিল হার্ভার্ডের উদ্দেশ্যে।
ছবিঃ MIT-তে হেনরি মুর-এর Three Reclying Figure
ছবিঃ MIT-তে হেনরি মুর-এর Three Reclying Figure
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি
হার্ভার্ড আমাদের হোটেল থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। আমরা আধাঘণ্টার মধ্যেই ক্যাম্পাসে চলে এলাম। আইভি লীগের হার্ভার্ড-কেও আমার নূতন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার নেই। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বই হার্ভার্ডের ছাত্র বা ছাত্রী ছিলেন যেমন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস (ড্রপ আউট), ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ (ড্রপ আউট); প্রথমেই আমরা ক্যাম্পাসের সামনে হার্ভার্ড স্কয়ারে গেলাম। এখানে কিছু খাবার দোকান, বুক-স্টোর ও আরো অন্যান্য দোকান আছে। আমরা Au Bon Pain থেকে সকালের নাস্তা করলাম। আমার মনে পড়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটারের সামনের ক্যাম্পাস শ্যাডো, টিএসসির ক্যাফেটেরিয়া ডাচ কিংবা আইবিএ-এর সামনের মধুর ক্যান্টিনের কথা। নাস্তা শেষে মুল ক্যাম্পাসের দিকে রওয়ানা দিলাম। ক্যাম্পাসটি আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এখানেও আছে অসংখ্য গাছপালা, প্রচুর ভাস্কর্য। John Harvard-এর নামে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে এবং হার্ভার্ডে John Harvard-এর একটি ভাস্কর্য আছে। আমরা সে ভাস্কর্যটি দেখলাম। উল্লেখ্য তিনিই প্রথম তার নিজের ৪০০ বইয়ের লাইব্রেরী ও তার নিজের সম্পত্তির অর্ধেক হার্ভার্ডকে দিয়ে গিয়েছেন।
ছবিঃ জন হার্ভার্ড
আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলটিও কিন্তু কম সুন্দর নয়। হার্ভার্ডের কিছু হলের স্থাপত্য আমার কাছে আমাদের কার্জন হলের মত মনে হয়েছে। হার্ভার্ডের ক্যাম্পাসের পরিবেশটি চমৎকার! আজকে বন্ধ বিধায় ক্যাম্পাসে তেমন ছাত্র-ছাত্রী দেখা যাচ্ছে না। আমি জানি লাইব্রেরী ছাড়াও এই ক্যাম্পাসের মাঠের এখানে সেখানে ক্লাসের শেষে নিজ নিজ বই-পত্র, ল্যাপটপ নিয়ে কিংবা গ্রুপ বেঁধে ছাত্র-ছাত্রীরা বসে পড়বে। আমার মনে পড়ে যায় কলম্বিয়ার ফাই-বেটা-কাপ্পা স্কলার টেড ফাইক-এর কথা। সি প্রোগ্রামিং-এর ক্লাসে তিনি টেক্সট বই নির্ধারণ করেছিলেন সি ল্যাঙ্গুয়েজ-এর প্রতিষ্ঠাতা Dennis Ritchie ও সহলেখক Brian Kernighan-এর লেখা বইটা। প্রথমে খুব এক্সাইটেড ছিলাম যে স্বয়ং সি-এর প্রতিষ্ঠাতা-র বইটা পড়ব কিন্তু তিনটা ক্লাস পার হওয়ার পর টের পেয়েছিলাম কত ধানে কত চাল। আমরা কলম্বিয়ার মাঠে দলবেঁধে আলোচনা, টিউটোরিয়াল করতাম। আসলে ছাত্রজীবনটা সবসময়েই চমৎকার। হার্ভার্ড, ইয়েল, কর্নেল, কলম্বিয়াসহ আইভি লীগের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও আরো অন্যান্য বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের স্থানটি ধরে রাখবে আর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই তার অতীতের সুনাম থেকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে ও যাবে-কিছুই করার নেই। এখানে হাঁটাহাঁটি করতে বেশ ভালোই লাগছিল কিন্তু আমাদের ভ্রমণে আরো অন্যান্য স্থানও অন্তর্ভুক্ত আছে। আমরা হার্ভার্ড পুরোটা দেখেতে পেলাম না কারণ এটা বিশাল। আমরা হার্ভার্ড ছেড়ে এবার এমআইটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
এমআইটি
এমআইটি আইভি লীগের মধ্যে নেই, তারপরেও এমআইটি-কে নূতন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছুই নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি।৭৭ ম্যাসেচুসেটস এভিনিউতে প্রধান প্রবেশ পথ দিয়ে আমাদের দলটি এমআইটিতে প্রবেশ করল। এখানে হার্ভার্ড বা ইয়েলের মত প্রবেশ করেই বিশাল খোলা মাঠ পাই নি। বিশাল একটি বিল্ডিং-এর মধ্য ঢুকে পড়লাম। ঢুকেই দেখতে পেলাম এমআইটি-র প্রতিষ্ঠার ১৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার লাগানো।
ছবিঃ এমআইটি
১৮৬১ সালের ১০ই এপ্রিল ম্যাসেচুসেটস-এর গভর্নর জন এন্ড্রু Act of Incorporation for the Massachusetts Institute of Technology স্বাক্ষর করেছিলেন। এভাবেই এমআইটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। লম্বা করিডোর ধরে এ্যাডমিশন অফিস পার হয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। পুরো এমআইটিতে ছড়িয়ে আছে চমৎকার সব স্থাপত্য। আমরা একে একে Chapel, Green Building, Kresge Auditorium, Simmons Hall, Wiesner Building, Landau Building দেখলাম। এখানে আছে হেনরি মুর-এর Three Reclying Figure ভাস্কর্যটি। চমৎকার এমআইটি শব্দে বর্ণনা করা খুবই কঠিন।
বোস্টন হার্বার ক্রুজ (Boston Harbour Cruise)
এমআইটি থেকে আমরা সরাসরি বোস্টন হার্বার ক্রুজ-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে গেল। আমি সাথে আমার ল্যাপটপটি নিয়ে গিয়েছিলাম। এটি সবসময়েই আমার সাথে রাখতাম। বাসে রাখিনি নিরাপত্তার জন্য যদিও নিরাপত্তার কোন সমস্যাই ছিল না। আমাদের আগে থেকে ঠিক করা জাহাজ অডিসি-তে ওঠার মুহূর্তে টের পেলাম যে সাথে আমার ল্যাপটপটি নেই। বন্ধু ‘জন’ বা কাজিন ‘শান্ত’ কারো হাতেই ল্যাপটপের ব্যাগটি নেই। কখন বা কোথায় আমার ল্যাপটপ হারালো তা জানার জন্যে জাহাজে উঠে ক্যামেরায় প্রিভিউ স্ক্রিনে সবগুলি ছবি দেখতে লাগলাম। এমআইটিতে থাকাকালীনও ল্যাপটপের ব্যাগটি আমার হাতে ছিল। এমআইটি থেকে বের হবার সময়ের ছবিগুলোতে আমার হাত খালি। নিশ্চিত হলাম যে, এমআইটিতে ছবি তোলার সময়ে খোলা মাঠে ল্যাপটপের ব্যাগটি রেখে ছবি তুলেছিলাম, তারপরে তুলে নিতে ভুলে গিয়েছি। এর মধ্যে আমাদের জাহাজ অডিসি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি ছিল দেড় ঘনটার একটি ক্রুজ। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ল্যাপটপের শোকে এখনকার আনন্দ মাটি করে লাভ নেই, তারচেয়ে বরং ক্রুজ শেষে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এমআইটি-তে গিয়ে দেখা যাবে। আমাদের ট্যুরটি বস্টন ইননার হার্বার থেকে রওয়ানা দিয়ে চার্লস নদী হয়ে আবার ইননার হার্বারে ফিরে আসার কথা। ট্যুরটিতে জাহাজ থেকে চারদিকে চমৎকার বোস্টন সিটি দেখা যায়।
ছবিঃ অডিসি থেকে বোস্টন সিটি
আমাদের জাহাজটি যখন হার্বার আইল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক কিংবা ওয়ার্কিং পোর্ট কিংবা বীকন হিল-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন অডিসির ধারাভাষ্যকার স্থানগুলির বর্ণণা ও ইতিহাস বলে যাচ্ছিল। আমাদের পাশ দিয়ে কিংবা বিপরীত দিক থেকে আরো জাহাজ, ওয়াটার ট্যাক্সি দেখতে পাচ্ছিলাম।
ছবিঃ ওয়াটার ট্যাক্সি
এছাড়া ঐ দিনটিতে আবহাওয়া ছিল চমৎকার। ল্যাপটপের শোক ভুলে থাকার জন্য ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, শুধু তাই নয় আমরা আমাদের সঙ্গী অতীব সুন্দরী ললনাদের সাথেও আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এমন একটা পরিবেশে পাশে সুন্দরী একটা মেয়ে না থাকলে ট্যুরটাই মাটি হয়ে যায়। আমাদেরটা হয়নি। আমরা টেরই পেলাম না যে, কখন আমাদের দেড় ঘণ্টার ক্রুজ শেষ হয়ে গেল।
কুইন্সি মার্কেট (Quincy Market)
কুইন্সি মার্কেটে নেমেই আমাদের ট্যুর গাইড বেরি-কে বলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা তিনজন চলে গেলাম এমআইটি-তে। নাহ, আমার পছন্দের ল্যাপটপটি আর পাওয়া গেল না। ঐদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে টুরিস্ট একের পর এক আসছিল, না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফিরে এলাম কুইন্সি মার্কেটে। এটা আমাদের সর্বশেষ জায়গা। দুপর গড়িয়ে গিয়েছে। লাঞ্চ করা দরকার।কুইন্সি মার্কেটে যাওয়ার পর পরই মনের মধ্যে একটা চঞ্চলতা এসে যায় কারণ এই মার্কেটটি অসম্ভব ব্যস্ত। অগণিত মানুষ। বিশাল একটা দালানের ভেতরে বিরাট একটি শপিং মল নয় এটি।বিশাল জায়গা জুড়ে এই মার্কেটটি। ইট বিছানো রাস্তা, দুইপাশে অসংখ্য কেনাকাটার দোকান। মাথার উপরে আকাশ। শুধুমাত্র কেনাকাটার দোকানই নয়, আছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট আর ফাস্ট ফুড।
ছবিঃ কুইন্সি মার্কেট
১৭৪২ সালে Peter Faneuil নামে বোস্টনের এক ধনী ব্যবসায়ী পাইকারি মার্কেট হিসেবে Faneuli Hall গড়ে তোলেন। এখানে লোকাল লোকজনের সমাগম ক্রমেই বাড়তে থাকে। তারপরে আরো ছয়টি স্ট্রিট নিয়ে ১৮০০ সালের দিকে কুইন্সি মার্কেটকে গড়ে তোলা হয়। বোস্টনের প্রাক্তন মেয়র Josiah Quincy-এর নামে এই মার্কেটটির নামকরণ করা হয়। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ১৮ মিলিয়ন দর্শনার্থী এই মার্কেটে আসেন। এছাড়া Faneuli Hall-এর পরেই আছে ফাইন্যান্সিয়াল ডিসট্রিক্ট, ওয়াটারফ্রন্ট, হে-মার্কেট (Haymarket)। কুইন্সি মার্কেটটি শুধুমাত্র আউটডোরই নয়। এটিতে আছে ২৭০০০ স্কয়ার ফিটের, দোতলা চমৎকার স্থাপত্যের একটি বিল্ডিং। এখানেও আছে ফুডকোর্ট। আমরা এখানে আমাদের লাঞ্চ করে নিলাম। পুরো মার্কেটটা ঘুরে ঘুরে দেখছি, ছবি তুলছি। রাস্তায় মেইন দোকান ছারাও আছে প্রচুর শপিং কার্ট। স্যুভেনিরও কিনলাম। রাস্তায় বিভিন্ন গায়কদল গান করছে। জমজমাট একটি পরিবেশে সময় বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু আমাদের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বিকেল ৫ টায় আমাদের বাস ছেড়ে যাবে এখান থেকে। ৫ টা বেজে গেল। বাসে চলে এলাম। আমাদের বাস বোস্টন ছেড়ে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
হার্ভার্ড আমাদের হোটেল থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। আমরা আধাঘণ্টার মধ্যেই ক্যাম্পাসে চলে এলাম। আইভি লীগের হার্ভার্ড-কেও আমার নূতন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার নেই। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বই হার্ভার্ডের ছাত্র বা ছাত্রী ছিলেন যেমন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস (ড্রপ আউট), ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ (ড্রপ আউট); প্রথমেই আমরা ক্যাম্পাসের সামনে হার্ভার্ড স্কয়ারে গেলাম। এখানে কিছু খাবার দোকান, বুক-স্টোর ও আরো অন্যান্য দোকান আছে। আমরা Au Bon Pain থেকে সকালের নাস্তা করলাম। আমার মনে পড়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটারের সামনের ক্যাম্পাস শ্যাডো, টিএসসির ক্যাফেটেরিয়া ডাচ কিংবা আইবিএ-এর সামনের মধুর ক্যান্টিনের কথা। নাস্তা শেষে মুল ক্যাম্পাসের দিকে রওয়ানা দিলাম। ক্যাম্পাসটি আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এখানেও আছে অসংখ্য গাছপালা, প্রচুর ভাস্কর্য। John Harvard-এর নামে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে এবং হার্ভার্ডে John Harvard-এর একটি ভাস্কর্য আছে। আমরা সে ভাস্কর্যটি দেখলাম। উল্লেখ্য তিনিই প্রথম তার নিজের ৪০০ বইয়ের লাইব্রেরী ও তার নিজের সম্পত্তির অর্ধেক হার্ভার্ডকে দিয়ে গিয়েছেন।
ছবিঃ জন হার্ভার্ড
আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলটিও কিন্তু কম সুন্দর নয়। হার্ভার্ডের কিছু হলের স্থাপত্য আমার কাছে আমাদের কার্জন হলের মত মনে হয়েছে। হার্ভার্ডের ক্যাম্পাসের পরিবেশটি চমৎকার! আজকে বন্ধ বিধায় ক্যাম্পাসে তেমন ছাত্র-ছাত্রী দেখা যাচ্ছে না। আমি জানি লাইব্রেরী ছাড়াও এই ক্যাম্পাসের মাঠের এখানে সেখানে ক্লাসের শেষে নিজ নিজ বই-পত্র, ল্যাপটপ নিয়ে কিংবা গ্রুপ বেঁধে ছাত্র-ছাত্রীরা বসে পড়বে। আমার মনে পড়ে যায় কলম্বিয়ার ফাই-বেটা-কাপ্পা স্কলার টেড ফাইক-এর কথা। সি প্রোগ্রামিং-এর ক্লাসে তিনি টেক্সট বই নির্ধারণ করেছিলেন সি ল্যাঙ্গুয়েজ-এর প্রতিষ্ঠাতা Dennis Ritchie ও সহলেখক Brian Kernighan-এর লেখা বইটা। প্রথমে খুব এক্সাইটেড ছিলাম যে স্বয়ং সি-এর প্রতিষ্ঠাতা-র বইটা পড়ব কিন্তু তিনটা ক্লাস পার হওয়ার পর টের পেয়েছিলাম কত ধানে কত চাল। আমরা কলম্বিয়ার মাঠে দলবেঁধে আলোচনা, টিউটোরিয়াল করতাম। আসলে ছাত্রজীবনটা সবসময়েই চমৎকার। হার্ভার্ড, ইয়েল, কর্নেল, কলম্বিয়াসহ আইভি লীগের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও আরো অন্যান্য বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের স্থানটি ধরে রাখবে আর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই তার অতীতের সুনাম থেকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে ও যাবে-কিছুই করার নেই। এখানে হাঁটাহাঁটি করতে বেশ ভালোই লাগছিল কিন্তু আমাদের ভ্রমণে আরো অন্যান্য স্থানও অন্তর্ভুক্ত আছে। আমরা হার্ভার্ড পুরোটা দেখেতে পেলাম না কারণ এটা বিশাল। আমরা হার্ভার্ড ছেড়ে এবার এমআইটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
এমআইটি
এমআইটি আইভি লীগের মধ্যে নেই, তারপরেও এমআইটি-কে নূতন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছুই নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি।৭৭ ম্যাসেচুসেটস এভিনিউতে প্রধান প্রবেশ পথ দিয়ে আমাদের দলটি এমআইটিতে প্রবেশ করল। এখানে হার্ভার্ড বা ইয়েলের মত প্রবেশ করেই বিশাল খোলা মাঠ পাই নি। বিশাল একটি বিল্ডিং-এর মধ্য ঢুকে পড়লাম। ঢুকেই দেখতে পেলাম এমআইটি-র প্রতিষ্ঠার ১৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার লাগানো।
ছবিঃ এমআইটি
১৮৬১ সালের ১০ই এপ্রিল ম্যাসেচুসেটস-এর গভর্নর জন এন্ড্রু Act of Incorporation for the Massachusetts Institute of Technology স্বাক্ষর করেছিলেন। এভাবেই এমআইটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। লম্বা করিডোর ধরে এ্যাডমিশন অফিস পার হয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। পুরো এমআইটিতে ছড়িয়ে আছে চমৎকার সব স্থাপত্য। আমরা একে একে Chapel, Green Building, Kresge Auditorium, Simmons Hall, Wiesner Building, Landau Building দেখলাম। এখানে আছে হেনরি মুর-এর Three Reclying Figure ভাস্কর্যটি। চমৎকার এমআইটি শব্দে বর্ণনা করা খুবই কঠিন।
বোস্টন হার্বার ক্রুজ (Boston Harbour Cruise)
এমআইটি থেকে আমরা সরাসরি বোস্টন হার্বার ক্রুজ-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে গেল। আমি সাথে আমার ল্যাপটপটি নিয়ে গিয়েছিলাম। এটি সবসময়েই আমার সাথে রাখতাম। বাসে রাখিনি নিরাপত্তার জন্য যদিও নিরাপত্তার কোন সমস্যাই ছিল না। আমাদের আগে থেকে ঠিক করা জাহাজ অডিসি-তে ওঠার মুহূর্তে টের পেলাম যে সাথে আমার ল্যাপটপটি নেই। বন্ধু ‘জন’ বা কাজিন ‘শান্ত’ কারো হাতেই ল্যাপটপের ব্যাগটি নেই। কখন বা কোথায় আমার ল্যাপটপ হারালো তা জানার জন্যে জাহাজে উঠে ক্যামেরায় প্রিভিউ স্ক্রিনে সবগুলি ছবি দেখতে লাগলাম। এমআইটিতে থাকাকালীনও ল্যাপটপের ব্যাগটি আমার হাতে ছিল। এমআইটি থেকে বের হবার সময়ের ছবিগুলোতে আমার হাত খালি। নিশ্চিত হলাম যে, এমআইটিতে ছবি তোলার সময়ে খোলা মাঠে ল্যাপটপের ব্যাগটি রেখে ছবি তুলেছিলাম, তারপরে তুলে নিতে ভুলে গিয়েছি। এর মধ্যে আমাদের জাহাজ অডিসি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি ছিল দেড় ঘনটার একটি ক্রুজ। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ল্যাপটপের শোকে এখনকার আনন্দ মাটি করে লাভ নেই, তারচেয়ে বরং ক্রুজ শেষে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এমআইটি-তে গিয়ে দেখা যাবে। আমাদের ট্যুরটি বস্টন ইননার হার্বার থেকে রওয়ানা দিয়ে চার্লস নদী হয়ে আবার ইননার হার্বারে ফিরে আসার কথা। ট্যুরটিতে জাহাজ থেকে চারদিকে চমৎকার বোস্টন সিটি দেখা যায়।
ছবিঃ অডিসি থেকে বোস্টন সিটি
আমাদের জাহাজটি যখন হার্বার আইল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক কিংবা ওয়ার্কিং পোর্ট কিংবা বীকন হিল-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন অডিসির ধারাভাষ্যকার স্থানগুলির বর্ণণা ও ইতিহাস বলে যাচ্ছিল। আমাদের পাশ দিয়ে কিংবা বিপরীত দিক থেকে আরো জাহাজ, ওয়াটার ট্যাক্সি দেখতে পাচ্ছিলাম।
ছবিঃ ওয়াটার ট্যাক্সি
এছাড়া ঐ দিনটিতে আবহাওয়া ছিল চমৎকার। ল্যাপটপের শোক ভুলে থাকার জন্য ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, শুধু তাই নয় আমরা আমাদের সঙ্গী অতীব সুন্দরী ললনাদের সাথেও আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এমন একটা পরিবেশে পাশে সুন্দরী একটা মেয়ে না থাকলে ট্যুরটাই মাটি হয়ে যায়। আমাদেরটা হয়নি। আমরা টেরই পেলাম না যে, কখন আমাদের দেড় ঘণ্টার ক্রুজ শেষ হয়ে গেল।
কুইন্সি মার্কেট (Quincy Market)
কুইন্সি মার্কেটে নেমেই আমাদের ট্যুর গাইড বেরি-কে বলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা তিনজন চলে গেলাম এমআইটি-তে। নাহ, আমার পছন্দের ল্যাপটপটি আর পাওয়া গেল না। ঐদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে টুরিস্ট একের পর এক আসছিল, না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফিরে এলাম কুইন্সি মার্কেটে। এটা আমাদের সর্বশেষ জায়গা। দুপর গড়িয়ে গিয়েছে। লাঞ্চ করা দরকার।কুইন্সি মার্কেটে যাওয়ার পর পরই মনের মধ্যে একটা চঞ্চলতা এসে যায় কারণ এই মার্কেটটি অসম্ভব ব্যস্ত। অগণিত মানুষ। বিশাল একটা দালানের ভেতরে বিরাট একটি শপিং মল নয় এটি।বিশাল জায়গা জুড়ে এই মার্কেটটি। ইট বিছানো রাস্তা, দুইপাশে অসংখ্য কেনাকাটার দোকান। মাথার উপরে আকাশ। শুধুমাত্র কেনাকাটার দোকানই নয়, আছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট আর ফাস্ট ফুড।
ছবিঃ কুইন্সি মার্কেট
১৭৪২ সালে Peter Faneuil নামে বোস্টনের এক ধনী ব্যবসায়ী পাইকারি মার্কেট হিসেবে Faneuli Hall গড়ে তোলেন। এখানে লোকাল লোকজনের সমাগম ক্রমেই বাড়তে থাকে। তারপরে আরো ছয়টি স্ট্রিট নিয়ে ১৮০০ সালের দিকে কুইন্সি মার্কেটকে গড়ে তোলা হয়। বোস্টনের প্রাক্তন মেয়র Josiah Quincy-এর নামে এই মার্কেটটির নামকরণ করা হয়। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ১৮ মিলিয়ন দর্শনার্থী এই মার্কেটে আসেন। এছাড়া Faneuli Hall-এর পরেই আছে ফাইন্যান্সিয়াল ডিসট্রিক্ট, ওয়াটারফ্রন্ট, হে-মার্কেট (Haymarket)। কুইন্সি মার্কেটটি শুধুমাত্র আউটডোরই নয়। এটিতে আছে ২৭০০০ স্কয়ার ফিটের, দোতলা চমৎকার স্থাপত্যের একটি বিল্ডিং। এখানেও আছে ফুডকোর্ট। আমরা এখানে আমাদের লাঞ্চ করে নিলাম। পুরো মার্কেটটা ঘুরে ঘুরে দেখছি, ছবি তুলছি। রাস্তায় মেইন দোকান ছারাও আছে প্রচুর শপিং কার্ট। স্যুভেনিরও কিনলাম। রাস্তায় বিভিন্ন গায়কদল গান করছে। জমজমাট একটি পরিবেশে সময় বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু আমাদের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বিকেল ৫ টায় আমাদের বাস ছেড়ে যাবে এখান থেকে। ৫ টা বেজে গেল। বাসে চলে এলাম। আমাদের বাস বোস্টন ছেড়ে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।