পরনোগ্রাফি: ইন্দ্রিয়ঘন অভিজ্ঞতা

,
ষাটের দশকে কয়েকজন কবি বিতর্কিত হয়েছিলেন যৌন বিষয়াদি নিয়ে খোলামেলা ভাষায় লিখে। তাঁদের মূল প্রেরণা ছিলেন তিরিশের কয়েকজন কবি। তবে তাঁরা সাহস পেয়েছিলেন পঞ্চাশ দশকের কয়েকজন কবির  যাঁরা নতুন সাহিত্য-আন্দোলন শুরু করতে গিয়ে শ্লীল-অশ্লীলতার বিতর্ক সৃষ্টি করে জড়িয়েছিলেন মামলা-মোকদ্দমায়। আমাদের ওই কবিরা সাহস দেখিয়েছিলেন আরও বেশি। তাঁদের লেখা দুর্নাম কুড়িয়েছিল ‘অশ্লীল’ বলে, অনেকে বলেছিলেন পরনোগ্রাফি-ও। আজকের পাঠকদের কাছে ওই লেখাগুলো যে নেহাৎ জোলো বা পানসে ঠেকবে তা জোর দিয়েই বলতে পারি আমি। তবে ওই কবিদের একজন সত্যি-সত্যি পরনোগ্রাফি লিখেছিলেন একটি। তখন ওগুলোকে বলা হতো ‘চটি বই’। এ রকম নাম হওয়ার কারণ, ও বইগুলোতে প্রচ্ছদ বা মলাট থাকতো না।
কোনও প্রকাশকের কথায় ওই কবি তৈরি করেছিলেন পাণ্ডুলিপি। ফুলস্কেপ সাইজের কাগজে ৭২ পৃষ্ঠা জুড়ে রগরগে ভাষায় তিনি লিখেছিলেন সম্ভব-অসম্ভব নানা রকম যৌনলীলার বিবরণ। তাঁকে আট আনা (৫০ পয়সা) দিয়ে এক ঘণ্টার জন্য ধার নিয়ে পড়েছিলাম সেটা। ওই কবি গদ্যের চর্চা করেন নি, করলে আমাদের সেরা কথাসাহিত্যিকদের একজন হতে পারতেন।
পাণ্ডুলিপিটি পরে চটি বই হিসেবে বেরিয়েছিল কিনা জানি না, তবে এর নাম তিনি রেখেছিলেন ‘জল ভরা তালশাঁস’। বলেছিলেন, ‘নামটি আমি চুরি করেছি কলকাতার এক বিখ্যাত চটি বইয়ের নাম থেকে।’ সেই বইটির নানা বিষয়ের ব্যাখ্যান করেছিলেন, কিন্তু সেটি চোখে পড়ে নি কখনও।
তখন কলকাতা থেকে এ সবের সরবরাহ কিছু আসতো, এখানেও ছাপা হতো কিছু। পরিচিত লেখক-সাংবাদিকরা সেগুলো লিখতেন বলে কানাঘুষা ছিল। ১৯৭০ সালে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল ‘কোলাহল’ নামের এক চটি বই। লেখার মুনসিয়ানার কারণে অনেকের সন্দেহের চোখ তখন পড়েছিল কয়েকজন নামী লেখকের ওপর। যত দূর জানি, এখনও অন্তত একজনের ওপর থেকে চোখ সরে যায় নি। ‘কোলাহল’-এর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন আরও কয়েকজন লেখক-প্রকাশক। চোরাবাজার ছেয়ে গিয়েছিল তাদের প্রকাশনায়। তবে সেগুলোর মধ্যে ‘শিহরণ’ নামের চটি বইটি সাফল্য পেয়েছিল কথঞ্চিৎ। সেটিও লিখেছিলেন কোনও একজন নামী লেখক, কিন্তু জমাতে পারেন নি তেমন। স্বাধীনতার পর ‘শ্রীমতি’ নামের এক পত্রিকা রীতিমতো হটকেক হয়ে গিয়েছিল এ ধারার গল্প, ফিচার, ছবি ছেপে। ওই পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন কয়েকজন পরিচিত লেখক।
চটি বই-পত্রিকার সেই ধারা অব্যাহত আছে এখনও। গুলিস্তান, বলাকা, আনন্দ প্রোগৃহের আশপাশে খোঁজ মেলে এ সবের। তবে পরনোগ্রাফি বলতে তো কেবল পড়ার বই বোঝায় না, দেখা ও শোনার সামগ্রীকেও বোঝায়। আর সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আর আবেদনও বদলে যায়। কাল যা ছিল গর্হিত আজ তা নিয়ে হাসাহাসি হতে পারে। পঞ্চাশ-ষাট দশকের পরিবেশটা কেমন ছিল তা একটু বলি। তখন শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ ও ‘চরিত্রহীন’, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের ‘পাপের ছাপ’, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘পিয়ারী’ প্রভৃতি বই নিয়ে ছিল প্রচণ্ড নাক সিঁটকানি। ঢাকার লেখকদের মধ্যে আবু যোহা নূর আহমদ (১৯০৭-১৯৭৩)-এর ‘যে যারে ভালবাসে’ (১৯৫৮), আ. ন. ম. বজলুর রশীদ (১৯১১-১৯৮৬)-এর ‘অন্তরাল’ (১৯৫৮), আকবর হোসেন (১৯১৭-১৯৮১)-এর ‘অবাঞ্ছিত’ (১৯৫০), বেদুইন শমসের (১৯১৯-১৯৬৪)-এর ‘বুড়িগঙ্গার বুকে’ (১৯৫৪) প্রভৃতি উপন্যাস পড়া দূরে থাকে নাড়াচাড়া করাতেও ছিল নিষেধের শাসন। পরনোগ্রাফি না হলেও সেভাবেই বিচার করতো সমাজ। মনে পড়ছে ‘কণ্ঠস্বর’-এ প্রকাশিত রফিক আজাদের ‘বেশ্যার বেড়াল’ কবিতাটি পড়ে হাত ধুয়ে ফেলেছিলেন কবি আবদুল কাদির। ইতিহাসের পরিহাস এই যে, এক সময় তাঁর কবিতা পড়েও হাত ধুয়েছেন অনেকে।
তবে খাঁটি যৌন বিষয়ক বই ও পত্রপত্রিকাও ছিল। পরনোগ্রাফি নামে পরিচিত সেগুলো থাকতো পিনবদ্ধ। ওই পিনের ওপর আঁটা থাকতো এক চিলতে কাগজ, তাতে ছাপা: “কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য”। কলকাতা থেকে আসতো ‘নরনারী’ নামের একটি পিনবদ্ধ পত্রিকা। পরে ঢাকাতেও ‘সচিত্র নরনারী’ নামে প্রকাশিত হয় একই রকম এক পিনবদ্ধ পত্রিকা। এ সব পত্রিকায় অবশ্য নামী সাহিত্যিকরাই গল্প-উপন্যাস লিখতেন। ‘যৌবনের ঢেউ’ নামে একটি যৌনশিামূলক বই ছিল পিনবদ্ধ। ১৯৬০ সালের দিকে বিশেষ ভাবে পরনোগ্রাফি হিসেবে চিহ্নিত হয় “সাঁচিবন্দর ফার্স্ট লেন” নামের এক উপন্যাসটি। এর লেখক সালাদীন (জ. ১৯৩৪, নোয়াখালী)। নিষিদ্ধ গলির যৌনকর্মীদের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের কাহিনী ভিত্তিক এ উপন্যাসটির জীবনানুগ বিশ্বস্ত বিবরণ প্রায় ফটোগ্রাফিক, রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল নানা মহলে। সে হৈচৈকে টেককা মারে ঈদ সংখ্যা সচিত্র সন্ধানী (১৯৬৯)-তে প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’। তারপর হুমায়ূন আজাদ ও তসলিমা নাসরিন সিরিয়াস সাহিত্য ও তুমুল পরনোগ্রাফির ভেদরেখা তো প্রায় মুছেই দিয়েছেন এখন।
অর্থ অনুযায়ী ‘সাঁচিবন্দর ফার্স্ট লেন’ খাঁটি পরনোগ্রাফি। গ্রিক ভাষা থেকে এসেছে শব্দটি। এর অর্থ “বেশ্যা বা বেশ্যাবৃত্তির লিখিত বিবরণ অথবা অঙ্কিত চিত্র”। শব্দটির প্রথম ব্যবহার কবে হয়েছে গ্রিক ভাষায় তবে যথা অর্থে এর প্রথম ব্যবহার ইংল্যান্ডে ১৮৫৭ সালের আগে হয় নি, আর মারকিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে ১৮৪২ সালে  ফরাসিদের দ্বারা নিউ অরলিয়ন্স-এ। অর্থ অনুযায়ী ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট এদুয়ার্দ মানে (১৮৩২-১৮৮৩)-র প্রখ্যাত শিল্পকীর্তি ‘অলিমপিয়া’ (১৮৬৩) অবশ্যই পরনোগ্রাফি। কারণ সেটি এক সভাসুন্দরী নগ্ন ছবি প্রকৃত অর্থেই এক বেশ্যার ছবি। সেকালে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল ‘অলিমপিয়া’।
এখন যে অর্থে আমরা পরনোগ্রাফি বুঝি তার নমুনা মেলে প্রাগৈতিহাসিক কালের অনেক গুহাচিত্রে, ভেনাস মূর্তিতে। প্রাচীন ভারতের অনেক মন্দিরে রয়েছে মিথুন মূর্তি, নগ্নিকা। সে সবের মধ্যে অজন্তা, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ‘কোনার্কসুন্দরীকে’ কবিতায় অমিতাভ দাশগুপ্ত লিখেছেন -
“সূক্ষ্মদন্তী, সুগভীর নাভি, জঘনগুরু
এ-কাক্সনীয় কামোদ্দীপক আলিঙ্গনের।
যোগ্য রমণী কার অভিসারে হঠাৎ পাথর,
ছেনি-বাটালির দাঁতে ঝুলে থাকে
ঠা-ঠা ভালবাসা!...”
১৮৬০-এর দশকে পমপেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ খনন করে পাওয়া যায় রোমানদের যৌন শিল্পকলার কতক অংশ। সেগুলো লুকিয়ে রাখা হয় নেপলসের গোপন জাদুঘরে।
তবে পরনোগ্রাফি-র বর্তমান যে অর্থব্যঞ্জনা তা ভিকটোরীয় যুগের সৃষ্টি। ১৭৪৮ সালে প্রকাশিত জন কিল্যান্ড-এর যৌন উপন্যাস ‘ফ্যানি হিল’কে বলা হয় প্রথম গদ্য পরনোগ্রাফি। সেকালে পরনোগ্রাফি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে কাসানোভা’র স্মৃতিকথা (১৮২২), হ্যারিয়েট উইলসন (১৭৮৬-১৮৪৫)-এর স্মৃতিকথা, হেনরি ফিলডিং-এর উপন্যাস ‘জোসেফ অ্যানড্রুজ’ (১৭৪২), ড্যানিয়েল ডিফো’র উপন্যাস ‘রোকসানা’ (১৭২৪), ফ্রাঙ্ক হ্যারিস-এর আত্মকথা (১৯২২-২৭), ডি এইচ লরেন্স-এর উপন্যাস ‘লেডি চ্যাটারলি’স লাভার’ (১৯২৮) প্রভৃতি বর্তমানে নন্দিত বই।
বৃটিশ ভারতে পরনোগ্রাফি’র বড় যোগান দিয়েছে বাৎসায়ন-এর ‘কামসূত্র’, যা সঙ্কলিত হয়েছিল দ্বিতীয় শতাব্দীতে। তবে ‘কামসূত্র’-এর অনুকরণে লিখিত অনেক বই বাজারে বিকোতো পরনোগ্রাফি হিসেবে। সেগুলোর মধ্যে ‘কোকশাস্ত্র’, ‘লজ্জতুন্নেছা’ প্রভৃতি এখনও বিকোয়। ওদিকে আরব্য উপন্যাসের রগরগে রূপ কলকাতার বটতলার সেরা সামগ্রী ছিল। আর ছিল শায়খ উমর ইবন মুহাম্মেদ আল নেফজাবি’র ‘সুবাসিত কানন’। তবে বটতলা পসার করেছিল কলকাতার নানা কেলেঙ্কারি আর রঙ্গিনী বারবনিতাদের কাহিনী ছেপে। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’, কেদারনাথ দত্তের ‘সচিত্র গুলজারনগর’, ভবানীচরণ মুখোপাধ্যায়ের ‘দূতীবিলাস’ প্রভৃতি অনেক বই ছাড়াও সাম্প্রতিক অনেক গবেষণাগ্রন্থে বিবরণ পাওয়া যায় সেকালের বটতলার চটি বইয়ের। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত মানদা দেবী’র ‘শিতিা পতিতার আত্মচরিত’ অবশ্য টেককা দিয়েছিল সবাইকে।
কোনারক সূর্যমন্দির দেখার পর প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক ও জীবনীকার মারি সিটন (১৯১০-১৯৮৫) যে লেখাটি লিখেছিলেন পরনোগ্রাফি সম্পর্কে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করে সমাপ্তি টানি এই সংপ্তি বৃত্তান্তের  “... সবচেয়ে সুসমঞ্জস রতিকলা যেমন, তেমনি সব শিল্পকলারই সৃজন বা উপভোগ একটি ইন্দ্রিয়ঘন অভিজ্ঞতা  যেখানে মিশে থাকে রক্তমাংস ও অধ্যাত্ম কিংবা মন ও শরীর, যে যেমন ভাবে বা বলে।... বাস্তব জগতের সীমানায় যে রতি ক্রিয়াশীল তারই মধ্য দিয়ে অর্জিত মানবিক সামর্থ্যরে আত্মপ্রকাশ। এই শিল্প নারীকে শ্রদ্ধা করে, পুরুষকে সম্মানিত করে। দেখাশোনা ও কল্পনার উচ্ছ্বাসময় সুস্থ আত্মপ্রকাশ এই শিল্প। আধুনিক বিশ্বের দিশাহারা এবং প্রায়ই নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত যে মানুষ, তার কাছে কোনারকের সবচেয়ে বড় শিা এই: তীব্র সংরাগ ও নম্র কোমলতা পরস্পরবিরোধী নয়, তারা একই মুহূর্তে সহাবস্থান করতে পারে।”

Partner site : online news / celebritiescelebrity image
website design by Web School.

0 comments to “পরনোগ্রাফি: ইন্দ্রিয়ঘন অভিজ্ঞতা”

Post a Comment