সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ : অভিবাসন প্রক্রিয়ায় আরো সতর্ক দৃষ্টি প্রয়োজন

,
প্রবাসে কাজ করতে গিয়ে বা অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার পথে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নানাভাবে মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে আমরা আগাগোড়াই পরিচিত। কখনো সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সলিল সমাধি, কখনো অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় গাড়ি উল্টে, কখনো দিনের পর দিন না খেয়ে পাহাড়ে, জঙ্গলে অথবা গুহায় লুকিয়ে অনেক তরুণের মৃত্যুর ঘটনা অসংখ্যবার আমাদের দৃষ্টিসীমায় এসেছে। তবে সব কিছুই যেন ছাপিয়ে গেছে সম্প্রতি সৌদি আরবে হত্যার অভিযোগে আট বাংলাদেশি তরুণের শিরশ্ছেদের ঘটনা। এ ঘটনার পর দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত তরুণদের পরিবার ও দেশের মানুষ শোকাহত হয়েছে। পত্রিকা পড়ে এবং টেলিভিশনে সংবাদ দেখে সাধারণ মানুষ বিস্মিত হয়েছে। কেননা এভাবে কারো মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রচলন আমাদের দেশসহ উন্নত কোনো দেশেই নেই। অনেকের কাছেই তাই মনে হয়েছে, এই সভ্যতা আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে এ ধরনের নির্মম মৃত্যুদণ্ড কতটা যুক্তিসংগত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এই মৃত্যুদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু এও ঠিক যে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ প্রচলিত বা স্বীকৃত বিচারব্যবস্থার ওপর অন্য কারো হস্তক্ষেপের সুযোগ কম। আরব দেশগুলোতে এই সুযোগ আরো সীমিত।
৭ অক্টোবর শুক্রবার সৌদি আরবে প্রকাশ্যে আট বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর তাদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী লাশ সে দেশেই দাফন করা হয়। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সবাই ২০০৭ সালের এপ্রিলে সৌদি আরবের রিয়াদে নির্মাণাধীন বিন লাদেন কম্পানির একটি গুদামে ডাকাতি, অস্ত্র লুট এবং ওই গুদামের মিসরীয় নিরাপত্তারক্ষী হুসেইন সাইদ মোহাম্মেদ আবদুল খালেককে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় সৌদি আরবের আইন অনুসারে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। কট্টর ইসলামী দেশ সৌদি আরবে এ ধরনের মৃত্যুদণ্ড সাধারণত প্রকাশ্যেই কার্যকর হয়।
বলা হয়েছে, শিরচ্ছেদ হওয়া আট বাংলাদেশিকে বাঁচানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল সরকার এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। জানা যায়, ২০০৭ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত স্বজনের সবাই জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) সহযোগিতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সৌদি সরকারের কাছে অভিযুক্তদের প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে এই মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফের জন্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা সব রকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে বলে প্রকাশ। সবশেষে রাষ্ট্রপতি অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফে সৌদি সরকার বরাবর আবেদন জানান। কিন্তু নিহত মিসরীয় হুসেইন সাইদ মোহাম্মেদ আবদুল খালেকের পরিবার ক্ষমা প্রদর্শন না করায় অভিযুক্ত বাংলাদেশি কর্মীদের প্রাণরক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এই আট তরুণকে বাঁচাতে সৌদি সরকারও চেষ্টা করেছিল বলে দাবি করা হয়েছে। ঘটনার দুদিন পর ঢাকায় সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ড. আব্দুল্লাহ আল বুসাইরি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, 'মিসরীয়র প্রাণের বিনিময়ে রক্তমূল্য (ব্লাড মানি) দিতে সৌদি সরকারও দেন-দরবার করে। আট বাংলাদেশিকে সৌদি আরবে তাদের অনুমোদিত নিজস্ব বিচার ধারায় শিরশ্ছেদ নিয়ে আমাদের আপত্তি-অভিযোগ থাকলেও স্বীকার করতেই হবে, এটি সে দেশের প্রচলিত নীতিরই অংশ। যুগ যুগ ধরে সে দেশে এভাবেই নিজ দেশ বা অন্য কোনো দেশের অভিযুক্তদের শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশের যে ৭৫ লাখ মাইগ্র্যান্ট শ্রমিক বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে কাজ করছে, এর মধ্যে সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিক সবচেয়ে বেশি। দক্ষ, অদক্ষ সব পেশার শ্রমিকই সৌদি আরবে কাজ করে। প্রতিবছর যে ফরেন রেমিট্যান্স আমরা পাই, তার সিংহভাগও আসে সৌদি আরব থেকে। অনেকেরই হয়তো জানা আছে, বেশ কয়েক বছর ধরে সৌদি আরব আমাদের দেশ থেকে নানা কারণে শ্রমিক আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে বিগত সরকার ও বর্তমান সরকার বহু দেন-দরবার করেও এখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের দরজা আগের মতো উন্মুক্ত করতে পারেনি। সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশ বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক নিতে অলিখিতভাবে অনীহা প্রকাশ করেছে। তবে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে এক শ্রেণীর শ্রমিকের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হওয়ার ঘটনায় শুধু যে শ্রমিকরাই দায়ী, তা নয়। কথিত শ্রমিক রপ্তানিকারক থেকে শুরু করে দালাল, ফড়িয়া এবং দূতাবাসগুলোতে কর্মরত যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাও এ জন্য কমবেশি অভিযুক্ত। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়ী এক শ্রেণীর কথিত দালাল, যারা বেশি মুনাফার লোভে অতিরিক্ত অভিবাসন ফি নিয়ে অদক্ষ শ্রমিকদের সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে থাকে। ফলে এভাবে মাইগ্র্যান্ট শ্রমিকরা তাদের ব্যয়িত অর্থ তুলতে নানাবিধ অসাধু ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, চার-পাঁচ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করার পরও একজন শ্রমিক ব্যয়িত অর্থ তুলতে পারেনি। শুধু বুকভরা বঞ্চনা, দুঃখ-কষ্ট আর ক্ষোভ নিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরে এসেছে। বলতে দ্বিধা নেই, আজ তারই ভয়ংকর খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে।
সৌদি আরবের ঘটনায় আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতা ও প্রবাসে বাংলাদেশিদের আইনগত সহায়তার ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। পররাষ্ট্রসচিব, বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিভাগের পরিচালক, রিয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ওই দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলরকে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
সৌদি আরবে যে ঘটনা ঘটল, এর জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটসহ নানা অনুষঙ্গ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে সরকারের প্রতি অনুরোধ, যে আট তরুণের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে তাদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে যেন আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়। সবশেষে বলব, পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা নিজেদের বদলাতে পারছি না। আর তাই বিদেশের মাটিতে কলঙ্ক, অপবাদ আমাদের মোটেও পিছু ছাড়ছে না। আট তরুণের শিরশ্ছেদ হওয়ার ঘটনায় অবশ্যই আমরা মর্মাহত, শোকাহত। আমাদের সবারই তাই চিন্তায়-উপলব্ধিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অবশ্যই অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় কমাতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিক রপ্তানিতে দক্ষতা, একাগ্রতা এবং বিশ্বস্ততার জায়গায় আমাদের গভীর দৃষ্টি দিতে হবে। এ থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে না পারলে আমাদের শ্রমবাজারে আরো অশনি সংকেত অত্যাসন্ন।

Partner site : online news / celebritiescelebrity image
website design by Web School.

0 comments to “সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ : অভিবাসন প্রক্রিয়ায় আরো সতর্ক দৃষ্টি প্রয়োজন”

Post a Comment