কলোরাডো! রকি মাউনটেন হাই

,
সন্ধ্যাবেলা লেখার টেবিলে বসেছি। উদ্দেশ্য, একটা ভয়ংকর ভূতের গল্প লিখব। বাংলাদেশের ভূতের গল্পে নরম-সরম ব্যাপার থাকে। আমাদের ভূত-পেতনিরা মাঝেমধ্যে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। রাতে গ্রামের কোনো বাড়িতে তরুণী বধূ ইলিশ মাছ ভাজছে। গন্ধে গন্ধে পেতনি উপস্থিত হবে। নাকি গলায় বলবে, ‘এঁকটা ভাঁজা মাঁছ দিঁবি?’
নিশিরাতে বাঁশগাছের ওপর বসে তারা গাছ ঝাঁকায়। খিক খিক করে হাসে। কেউ কেউ বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গৃহস্থের নাম ধরে ডাকে। এসব।
আমেরিকান ভূতেরা ভয়ংকর। সিরিয়াল কিলার টাইপ। তাদের মধ্যে মানবিক কোনো ব্যাপারই নেই। সবই ‘ভূতবিক’ ব্যাপার।
আমার চেষ্টা বাংলাদেশের পটভূমিকায় আমেরিকান ভূতের গল্প লেখা। কলজে কাঁপানো ভয়ংকর গল্প।
লিখতে বসে দেখি ভূতের গল্প আসছে না, গান আসছে। আমি ভাবলাম, গান অনেক দিন লেখা হয় না। একটা লেখা হোক। লেখা হলো।
শাওন পড়ে বলল, গান হয়নি, কবিতা হয়েছে।
আমি বললাম, কবিতাও হয়নি। ছন্দের ত্রুটি আছে। তবে দুর্বল এই কবিতায় সুর বসালেই ত্রুটি কাটবে।
শাওন বলল, সুর বসালেও এই গান যেন কখনো গীত না হয়। এই গানে শাওনের নাম এসেছে। কোনো পুরুষ-গায়ক হুমায়ূন আহমেদ সেজে আমার নাম নিয়ে গান করবে, তা হবে না।
আমি বললাম, ঠিক আছে। সুর বসুক। তোমাকে কথা দিলাম, এই গান গীত হবে না।
প্রয়াত সংগীতকার সত্য সাহা আমাকে বলেছিলেন, হুমায়ূন ভাই, আপনি একটা পত্রিকার পলিটিক্যাল সাব-এডিটরিয়াল আমাকে এনে দিন, আমি সুর করে দেব।
সত্য সাহা নেই। তাঁর পুত্র ইমন সাহা আছে। দেখি, সে কিছু করতে পারে কি না। আশা কম। পুত্র এখনো পিতাকে ছাড়িয়ে যায়নি।
ইমনের একটি গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। সে আমার ঘেঁটুপুত্র কমলা ছবির মিউজিক ডিরেক্টর। প্রায়ই তার স্টুডিওতে কাজ কত দূর হলো দেখতে যাই। সে দুনিয়ার মিষ্টি কিনে আনে, যদিও জানে, ডায়াবেটিস নামের ব্যাধির কারণে হতাশ চোখে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার কিছু করার নেই। সে সম্ভবত আমার হতাশ দৃষ্টিটাই দেখতে চায়। হাঃ হাঃ হাঃ।
যে রাতে কর্কট ব্যাধির চিকিৎসার জন্য ঢাকা থেকে রওনা হব, সেই রাতে সে আমাকে দেখতে এল। তার মুখে কোনো কথা নেই। সে এসেই আমার বাঁ হাত ধরে কচলাকচলি করতে লাগল। একপর্যায়ে আমি বললাম, ইমন, তোমার সমস্যা কী? তুমি তো আমাকে অচল করে দিচ্ছ।
ইমন লজ্জিত গলায় বলল, স্যার, দুই দিন আগে আমি আপনাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছি। এই জন্য এমন করছি। স্বপ্নটা বলব?
বলো।
আমি দেখেছি, আপনি ঘেঁটুপুত্র কমলার মিউজিক শুনতে এসেছেন। আপনার শরীরটা ভালো না বলে সোফায় শুয়ে আছেন। আপনার শরীরের খোঁজ নেওয়ার জন্য আমি আপনার কাছে গেলাম। গিয়েই চমকে উঠে দেখি আপনি না। আমার বাবা শুয়ে আছেন। আমি ছুটে গিয়ে বাবার হাত ধরলাম। অনেকক্ষণ ধরে থাকলাম, তারপর ঘুম ভেঙে গেল।
আমি বললাম, ইমন! তুমি তো ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছ। তুমি তোমার মৃত বাবার হাত কচলে এখন আমার হাত কচলাচ্ছ। আমাকেও মৃত বানানোর চেষ্টা?
বেচারার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। সে আমার হাত ছেড়ে দিল। আমি বললাম, ঠাট্টা করছি। তুমি আমার দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছ। আমার ঠাট্টা-তামাশায় অভ্যস্ত হতে হবে। একটা কথা তোমাকে বলি, গানবাজনায় তোমার উন্নতিতে তোমার স্বর্গবাসী পিতা যেমন খুশি হবেন, আমিও ঠিক তেমনি খুশি হব। এখন আমার ডান হাতটা কচলাও। দুটি হাত ব্যালান্স হওয়া প্রয়োজন।
আচ্ছা, এখন দুর্বল কবিতা পড়া যাক। যাদের ভেতরে সুর আছে তারা দয়া করে সুর বসিয়ে পড়ুন।
ডেনভার থেকে হঠাৎ নিমন্ত্রণ
সেখানে নাকি উৎসব হবে
সারা রাত জেগে জ্যাজ সংগীত।
গিটারের ঝনঝন\
জ্যাজ আমার প্রিয় গীতি তা কি হয়?
মনে তাই জাগে কঠিন এক সংশয়
কোনো অজুহাতে ‘যাব না’ বলব কি?
বড় অভিমানী, ডেনভারবাসী শাওনের পূরবী দি।
তাঁর দুই চোখে সুরমা ও কুশিয়ারা
তুচ্ছ কারণে নামে দুই নদীধারা।
আমি বললাম, ‘যাব’।
পূরবী কারণে ডেনভারে ধরা খাব।
দুঃখ ও শোকে ক্লান্ত থাকবে মন
সারা রাত জেগে জ্যাজ সংগীত
গিটারের ঝনঝন।
উৎসব শেষ, আমিও শেষ প্রবল জ্বরে কাতর।
আমার কপালে হাত রেখে দেখি শাওন হয়েছে পাথর।
জ্বর কিছু নয়, তার চেয়ে ভয় ক্যানসার আছে পিছু।
আমি বললাম, শাওন, জানো কি?
রকি মাউনটেন হিমালয়েরও উঁচু।
শাওন বলল, তোমার মাথা এলোমেলো তাই বিশ্রাম প্রয়োজন।
ভুল হয়েছে উৎসবে আসা
গিটারের ঝনঝন।
আমি বললাম, এসো। বাজি রাখো। রকি মাউনটেন হাই
তার আশপাশে কোনো পর্বত নাই।
কে বলেছে জানো?
জন ডেনভার! মন দিয়ে শুধু শোনো।
মধুক্ষরা স্বরে তিনি গেয়েছেন,
‘রকি মাউনটেন হাই’
কাজেই তার চেয়ে উঁচু পর্বত
এই পৃথিবীতে নাই।
পরের দিনের কথা।
গায়ের জ্বর আরও বেড়েছে, নিঃশ্বাসে বড় কষ্ট।
শরীর ও মন অচল আমার
বিষয়টা হলো স্পষ্ট।
তাতে কী হয়েছে, শাওন তো আছে।
তাকে নিয়ে যাব রকি পর্বতে
শাওন গাইবে মধুমাখা স্বরে
রকি মাউনটেন হাই
কলোরাডো! রকি মাউনটেন হাই
ডেনভারে যাওয়ার আগেই এই গান লেখা। গান শুনে মনে হতে পারে, নিতান্ত অনিচ্ছায় শুধু পূরবীর মন রক্ষায় সেখানে গেছি। ‘ইহা সত্য নহে।’ আমি ডেনভার গেছি দুই পুত্রকে ডেনভার দেখাতে এবং শাওনকে রকি পর্বতমালা দেখাতে।
রকি পর্বতমালা নিয়ে আমার নস্টালজিয়া আছে। কী নস্টালজিয়া, তা ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছি না।
পাদটীকা
পাঠকের যেমন মৃত্যু হয়, শ্রোতারও মৃত্যু হয়। অতি প্রিয় গান একসময় আর প্রিয় থাকে না। তবে কিছু গান আছে, কখনো তার আবেদন হারায় না। আমার কাছে মরমি কবি গিয়াসুদ্দিনের একটি গান সে রকম। ওল্ড ফুলস ক্লাবের প্রতিটি আসরে একসময় এই গান গীত হতো। শাওনের প্রবল আপত্তির কারণে এই গান এখন আর গীত হয় না। গানটির শুরুর পঙিক্ত—
মরিলে কান্দিস না আমার দায়
ও জাদুধন! মরিলে কান্দিস না আমার দায়।

Partner site : online news / celebrities /  celebrity image
website design by Web School.

0 comments to “কলোরাডো! রকি মাউনটেন হাই”

Post a Comment