Sat, 30/07/2011 - 11:37am | by Marzina.Afsar.Rozi
প্রভাতের সি্নগ্ধ কোমল-রেশম আলো চোখের পাপড়ি ছুঁইয়ে গেলে যে মেয়ে
দৃষ্টি মেলে অনাগত দিনের সফলতা আর সুমধুর স্বপ্নকে লালন করে। পৃথিবীকে
দেখছে সে মাত্র ১৪-১৫ বছর ধরে। শিশুকাল থেকেই অধ্যবসায় ও সাধনার মাধ্যমে বড়
হতে হয়। এ ধ্যান-জ্ঞান স্মরণে রেখে সর্বদাই ছুটেছে পরীক্ষার সন্তোষপূর্ণ
ফলাফলের দিকে। পিতা-মাতাসহ নিকট আত্মীয়দের সম্মানিত করার জন্য ঐটুকু কচি
দেহ-মনে প্রচেষ্টা নিরন্তর ছিল। প্রতিদিন যে কিশোরী একটু একটু করে পৃথিবীকে
আবিষ্কার করতো বিস্ময় আভাসে। কিন্তু কখনো তার ঘূর্ণাক্ষরেও মনে হয় নেই যে
হাঙ্গর, কুমির, দৈত্য-দানব তার চারপাশেই মানুষের মুখোশ পরিধান করে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। সময়-সুযোগ পেলেই বিশাল হাঁ করে বিষদাঁত ফুটিয়ে দেবে তার নিষ্পাপ
দেহবরণে। প্রতিটি পুরুষই মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভ করে আবার কন্যা সন্তানের
জনক হয়। তথাপিও কী করে পারে সন্তানতুল্য অথবা আদরের ছোটবোন তুল্য নিজ
ছাত্রীটিকে পৈশাচিক লালসার শিকার করে চরম লজ্জাজনক আর অপমানজনক এ রকম জঘন্য
নোংরা পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিতে।
বাংলাদেশের মেয়ে শিশু, বালিকা, কিশোরী, তরুণী, যুবতী, মধ্যবয়সী এবং
বৃদ্ধকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সুযোগে মনগড়া নিয়মে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে।
কিন্তু বর্তমানে এ নির্যাতনের আধিক্য আর বহুমাত্রিক রূপ বিশেষ করে
নিত্য-নতুন পদ্ধতিতে, আঙ্গিকে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে। গত ৫ জুন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপিকা রুমানা মঞ্জুরের
ওপর তার স্বামীর বর্বর আক্রমণের পরই আবার রাজধানীর সুনামখ্যাত স্কুল
অ্যান্ড কলেজ ভিকারুননিসার দশম শ্রেণীর ছাত্রী কোচিং করতে গিয়ে বাংলার
শিক্ষক পরিমল জয়ধর দ্বারা প্রতারণা ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়। গত ৫
জুলাই প্রকাশিত ওই খবরটিতে হীম হয়ে যায় স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ। এর সঙ্গে
কয়েকটি প্রশ্ন অজান্তে বিবেকের কড়া নারে। কে এই জয়ধর, তার বিস্তারিত পরিচয়
কী? কীভাবে সে নিয়োগ পেল এমন একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে? একদিনে তার
দুঃসাহস পাহাড়ের চূড়ায় ওঠেনি। এর পশ্চাদে ইন্ধন আছে, আশ্বাস আছে এবং
কুপ্ররোচনা রয়েছে। পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজনের আদরের কন্যাটি যদি বিদ্যার্জন
করতে গিয়ে স্বয়ং গুরুদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয় সে যন্ত্রণার গভীরত্বের পরিমাপ
ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। মা-বাবা কীভাবে নিজেদের
সান্ত্বনা দেবেন এমন অবস্থায় তাদের বুকের ধন লুণ্ঠিত হয়েছে_ যেখানে যাওয়ার
ব্যবস্থা তারাই অর্থ ব্যয় করে করে দিয়েছেন। অসহায় এ অবস্থা থেকে মানুষকে
মুক্তি দিতে জাতিকে আরো কঠোর, নিয়মতান্ত্রিক আর সুপরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর
হতে হবে। জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে সুনিপুণভাবে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন এবং
চরিত্রের সততা বজায় রাখার মানবিক শিক্ষা পরিবার থেকেই দেয়া উচিত।
সুস্থ-পবিত্র পারিবারিক বন্ধনে বেড়ে উঠলে কেউ এরকম হিংস্র-পশু হতে পারে না।
এই একবিংশ শতাব্দীতে ও বাংলার গ্রাম-গঞ্জে ফতোয়ার শিকার হয়ে অথবা
গ্রাম্য সালিশিকারকদের চাপায় পরে অসহায় নারীদের, ব্যভিচারিণী, কলঙ্কিনী,
অসত্য খেতাব নিয়ে দোররা, প্রহার, স্থান ত্যাগ, একঘরেসহ কত ধরনের বিচার করেন
সমাজপতিরা। এই পরিমলের বিচার কতখানি দৃষ্টান্তমূলক হবে, অপরাধের তুলনায়
কতটা যন্ত্রণাদায়ক হবে সে দৃশ্য দেখার জন্য উদগ্রীব আতঙ্কিত অভিভাবক মহল।
কলেজের অধ্যক্ষার দম্ভ তিনি পরিয়ে দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী আর
পরিমলের শক্তি তার নিয়োগ হয়েছে দলীয় হস্তক্ষেপে আর তার গ্রামের বাড়ি
গোপালগঞ্জ। সে কারণেই সুধীজনে বলে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ মৌলিক
উদ্দেশ্যকে মস্নান করে দেয়। একটি ছাত্রী ধর্ষিত হলে তার গোটা পরিবারটি
ধ্বংস হয়ে যায়। নিভে যায় ভবিষ্যতের ঘরে জ্বালানো আশার প্রদ্বীপ শিখা। অবুঝ
নিষ্পাপ শিশুটির মানে জন্ম নেয় সমগ্র পুরুষজাতি সম্পর্কে অশ্রদ্ধা, ক্ষোভ
এবং ঘৃণা। পরবর্তী জীবনে ইতিবাচক এবং কল্যাণকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ তার জন্য
কষ্টসাধ্য হয়। পুরুষ মানুষের ভেতর লুকায়িত নোংরা, জঘন্য পশুত্বের যে নগ্ন
চিত্র তার সামনে উন্মোচিত হয়ে যায় তাতে তার সুস্থ-সুন্দর-স্বাভাবিক গতি
মন্থর হয়ে যায়। অক্লান্ত শ্রম নিয়োগ করে মেধা বিকাশের যে উদ্যোগ তার সুপ্ত
ছিল হঠাৎ বজ্রপাতে তা নিমিষে হারিয়ে যায়। সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিকতার অভাব
এবং বিস্তৃতি দুর্নীতির কারণে আজ নীতিবান, আদর্শবান এবং সজ্জন মানুষের বড়ই
অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
দুর্নীতিগ্রস্ত ঘুনে ধরা সমাজ ক্ষয়ে-পচে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। আর
সে দৃশ্য আমাদের অসহায়ের মতো দেখতে হচ্ছে। প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত ওই অসুস্থ
সমাজের ঘূর্ণিপাকে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে কতশত কিশোরী। সুশীল সমাজ নীরব,
সরকার দায়িত্বহীন রক্ষকরা রূপান্তরিত হয়েছে ভক্ষকে। এ অবস্থায় মুক্তির পথ
কোথায়? শিক্ষার আলো, অনুশীলন যখন কোনো মানুষকে চরিত্রের সততা, নিয়ন্ত্রিত
যৌনক্ষুধা এবং দায়িত্বশীল হয়ে ভূমিকা পালন করতে শিখায় না তখন তাকে ঘাড় ধরে
আইনের কঠোর অনুশীলন এবং বাধ্যতা দিয়ে জব্দ করতে হয়। পত্রিকায় ওই পশুটির
ছবির দিকে গভীর দৃষ্টি মেলে বোঝা গেল অপরাধ করে অনুশোচনার বদলে
আত্মতৃপ্তিতে ভরে আছে তার অন্তর। শিক্ষক হওয়া উচিত পিতৃতুল্য, সমাজের
অন্যান্য আপদ-বালাই থেকে ছাত্রীকে রক্ষা করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।
দার্শনিক রোজার্স বহুকাল আগে একটি বাণী দিয়েছিলেন, যে শত্রুকে আমরা
সন্দেহ করি না তারাই বিপজ্জনক হয়ে থাকে। শিক্ষকদের সম্পর্কে ছাত্রীদের
হৃদয়ে পাহাড় সমান শ্রদ্ধাভক্তি থাকে আর ওই পাষ-গুলো সে সুযোগটাই কাজে
লাগায়। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে এদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কয়েকটি মাত্র জনসমক্ষে প্রকাশ হয়। বাকিগুলো থাকে খবরের অন্তরালে। হারমান
মাইনর স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রী ভ্যানওয়ালা কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছে।
শরীয়তপুরে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক বিনা বেতনে অধ্যয়নের আশ্বাস দিয়ে শিক্ষক
রুমে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। অবশেষে লজ্জায়-অপমানে আত্মহত্যা করেছে অসহায়
দশম শ্রেণীর ছাত্রীটি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো এমন একটি পবিত্র জায়গায় না
ফোটা কলিগদের কিছু হিংস্র, উন্মাদ, কামনালোভী বিকৃত রুচির পুরুষ মানুষ
দ্বারা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে বৃন্তচ্যুত করার নিরন্তর এ জঘন্য
ধারাটির অবসান কবে হবে। এ কথা আজ সর্বজন স্বীকৃত যে, সমাজে মেয়েরা আপন-পর,
ঘরে-বাইরে, আড়ালে-প্রকাশ্যে কোথাও নিরাপদ নয়। এটি এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়
যা ব্যাপক প্রকাশ করে সাক্ষী-সাবদ নিয়ে জনসমর্থন সঞ্চয় করে প্রতিকার
চাওয়াও যায় না। ইজ্জত-সম্মান-মান-মর্যাদা কেবল মেয়েটিই হারাতে থাকে।
ধর্ষণের শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদ- আর শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ অথবা
যে কোনো ধরনের যৌন নিপীড়নের শাস্তি হওয়া উচিত প্রকাশ্যে মৃত্যুদ-। এ মহা
অপরাধ খুনের চেয়ে কিছু কম নয়। বরং বেশি। খুন হলে তো মরে গিয়ে মুক্তি পায়,
কিন্তু বিশ্রি অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে সারাটা জীবন দুর্বিষহ কষ্টের মেঘে ছেয়ে
যায়। এমন কিছু অপরাধ আছে যে অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা হলেও মনে হয় শাস্তিটা
কম হয়ে গেছে। এটি এমনই একটি অপরাধ যে অপরাধের মার্জনা স্রষ্টার নিকটেও নেই।
পরিমলের স্ত্রী এবং সন্তানদের উচিত কুৎসিত মানসিকতার এই লোকটিকে
পারিবারিকভাবে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা। এমন চরিত্রহীন বিকৃতি লালসায় আক্রান্ত
অসভ্য মানুষটি কারো স্বামী কিংবা কারো পিতা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তাদের
কাছে নিজ সন্তানও নিরাপদ নয়। অসংযমী যৌনাকার দানবদের পারিবারিক, সামাজিক
এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বসবাস করার কোনো অধিকার নেই। আইন তাকে শারীরিকভাবে
শাস্তি দিক, কিন্তু শুদ্ধিতা এবং পাপমোচনের কঠিন শাস্তি গৃহ থেকেই দিতে
হবে। একক প্রচেষ্টায় যেমন একজন ভালো হতে পারে না তেমনি একার দোষে কেউ খারাপ
হয় না। তার বিগত জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কিছুতেই এ অবক্ষয় থেকে রেহাই
পাবে না। এ কথাটি আবারো স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, পুথিগত বিদ্যা আত্মস্থ
করলেই কেউ শিক্ষিত হয় না, সুশিক্ষিত হতে গেলে জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেককে জাগ্রত
করে মানবীয় গুণাবলীর বিন্যাস ঘটাতে হয়। সবশেষে রাজ্যের সব ঘৃণা-ধিক্কার ও
অভিসম্পাদ পরিমলের জন্য নির্ধারিত রেখে অভিযুক্ত স্কুলের সব প্রতিবাদী
ছাত্রীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে দায়ী ব্যক্তিটির ফাঁসির দাবি করছি।
পরিমলের মতো পশুর জন্ম যেন কোনো মাতৃগর্ভে না হয়। সন্তানকে একজন ভালো
মানুষ হিসেবে গড়তে পিতা-মাতাকে আদর্শবান হতে হয়। সে সঙ্গে সব কন্যা শিশুর
মায়েদের প্রতি অনুরোধ রইল, শুধু বিদ্যা-শিক্ষা না_ ঘুনে ধরা সমাজের চারপাশে
ওঁতপেতে থাকা হিংস্র জানোয়ারদের সম্পর্কেও সচেতন করে তুলতে হবে। শারীরিক
শক্তি ও দূরদর্শিতার তালিম দিয়ে ভবিষ্যতের পথ দেখাতে হবে।