নারীরা কি সম-অধিকারের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন?

,
একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমার কত কিছুই যে ভাবনায় আসে, তা ভেবে আমি নিজেই বিরক্ত হই। ভাবব না ভেবেও অনেক কথা ভেবে ফেলি, আবার তা লিখেও ফেলি। আমরা নারী মানুষরা অনেক সচেতন, আমাদের অধিকার নিয়ে। মাঝেমধ্যে এই ভাবনা সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু আসলেই কি আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে সচেতন? আমাদের মর্যাদা নিয়ে আমরা কতটা ভাবি? কোথাও কোনো লাইনে দাঁড়াতে সম-অধিকার পেলে, বাসে কিছু সংরক্ষিত আসন পেলে, নারী দিবসে কিছু বিশেষ গুরুত্ব পেলে বা সংসারে পুত্রসন্তানের সঙ্গে খাদ্য-শিক্ষায় সমভাগ পাওনা আদায় করতে পারলেই আমাদের অধিকার আদায় হচ্ছে ভেবে পরিতৃপ্ত হই। কিন্তু তাতেই যে আমাদের সঠিক মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছি না তা কি আমরা এই নারী মানুষরা বুঝতে পারছি? না, পারছি না। এখনো আমাদের বিপণনের বিশেষ পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা মোটেও সচেতন নই। কোনো অফিশিয়াল অভিষেক, বিশেষ কোনো সভা-সম্মেলনে সুন্দর পোশাকে নারীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে অযাচিতভাবে নারীর সৌন্দর্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বিলবোর্ডগুলোতেও তার যথেচ্ছ ব্যবহার। এটা আমাদের অজান্তে হচ্ছে, না আমরা নিজেরাই নিজেদের ব্যবহার করছি, তা কি কখনো ভেবে দেখেছি? একজন নারীর যেমন সৌন্দর্য আছে, তেমনি আছে পুরুষেরও।
সেখানে নারীরাই শুধু কামোদ্দীপক, এই ভাবনা কোথা থেকে আসে? এটা কি পুরুষশাসিত সমাজের ভাবনা থেকে আসে না? আর আমরা কিনা তাতে প্রচ্ছন্ন সায় দিয়ে নিজেরাই পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি! পাঠকরা ভেবে দেখুন, একটা শেভিং জেল বা ব্লেডের বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থিতি ছাড়া আর কোনো পথ কি আসলেই নেই! অধুনা দেখছি, আমের জুসের একটা বিজ্ঞাপন_সেটা দেখে যারপরনাই বিস্মিত আমি। সে বিজ্ঞাপনের নায়ক শৈশব-কৈশোরে আমের ছলনায় হতাশাগ্রস্ত। ভালো কথা। যৌবনেও আম তাকে ছলনা করছে, ঠিক সে সময়ই দেখা যায় নারীর উত্তেজক পৃষ্ঠদেশ। এর সঙ্গে আমের সম্পর্ক? বৃদ্ধাবস্থায় আম চুপসানো বেলুন হয়ে তার হাতে নিষ্পেষিত! এখানে কি বলা হয়েছে? এ রকম দ্বৈত অর্থবোধক বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণকারী নারী কি জেনেবুঝে অভিনয় করেছেন? আমাদের মানবাধিকার অধিদপ্তরের নারী আইনজীবীরা একটু মনোযোগ দিলে আমি খুবই খুশি হব। পথে চলতে চলতে বিশাল বিশাল হোর্ডিংয়ে নারীদের উপস্থিতিও আমাকে বিব্রত করে। ভারতীয় একটা গয়নার কম্পানি সারা দেশে উদোম গায়ে নারীদের গয়না পরিয়ে দিগন্তজুড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের কোন মা-বোন-কন্যা দামি গয়না গায়ে তুললে জামা পরা ভুলে যান, এটা আমার জানতে ইচ্ছে করে! সেই হোর্ডিংগুলোতে ব্লাউজ ছাড়াও অথবা একচিলতে বক্ষবন্ধনী পরে শাড়িতে নিজেকে উদ্ভাসিত করেছেন।
আমাদের দেশে অতি নিম্নবিত্ত নারীরা কাপড়ের অভাবে অনেক সময় ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরেন, সেটা তাঁদের সৌন্দর্যকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে নয়, এটা বলাই বাহুল্য। মানুষ আদিম যুগে কাপড় আবিষ্কারের আগে উদোম থাকত, ক্রমান্বয়ে তারা উপায় না পেয়ে গাছের পাতা, পশুর চামড়া দিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করেছে। মানুষ যত ভদ্র হওয়া শুরু করল, ততই তার লজ্জা বাড়ল। কাপড় দিয়ে শরীর ঢাকা একটা শিক্ষার অংশ হয়ে দাঁড়াল। আমাদের এই বাংলাদেশ, বাংলা সংস্কৃতি, একটা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে সব সময়। তারা অন্য মুসলিম রাষ্ট্রের মতো কালো জুব্বাও পরে না, আবার পাশ্চাত্যের মতো কাপড়ও খোলে না। অথচ এখন জামাকাপড়ের বাঁকগুলোতে নারীকে উদ্ভাসিত করার চেষ্টা চলছে জোরেশোরে। মশারির জালের শাড়ি, হাঁটু পর্যন্ত সালোয়ার_এগুলোকে সভ্যতা জানলে আমি অন্তত তা মানি না। এখনো আমাদের দেশে পুরুষরা এমন কাপড়ে ও এই পোশাকে পরনারীকে দেখে চোখ জুড়ালেও নিজের স্ত্রী-মা-বোনকে এমনভাবে দেখতে পছন্দ করেন না। তার মানে, মৌলিক ভাবনায় তাঁরা এখনো সেটা মেনে নিতে পারেননি। তাহলে? আর একটা কথা বলি, পুরুষদের কি উত্তাল সৌন্দর্য নেই? তারা কিন্তু কাপড় খোলেন না যথাতথা! অন্যকে ব্যবহার করতেই বোধ করি তাদের স্বাচ্ছন্দ্য।
আমরা কেন আমাদের ব্যবহার করার অবাধ সুযোগ করে দেব? আর একটা কথা বলি, আসল সৌন্দর্য আসে অভিজাত পোশাকে, সে পোশাক অবশ্যই মার্জিত হতে হয়। ৬৮ হাজার মাখলুকাতের মধ্যে একমাত্র মানুষই তার লজ্জা ঢাকতে কাপড় পরে। নারীর যথেচ্ছ ব্যবহার ও কাপড়হীনতায় আর যা-ই হোক, নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা হয় না। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে এই পৃথিবীতে পুরুষরাই কিন্তু সহজাত সৌন্দর্যের অধিকারী। পুরুষ পশুরাও। যেমন_বাঘ, সিংহ, ময়ূর পাখি_সব শ্রেণীতেই পুরুষরা কেশর, পেখম, ঝুটি ইত্যাদির অধিকারী। আর মানুষ পুরুষ? তারা কি লিপস্টিক মাখে? গালে রং মাখে, চোখে আলগা পাপড়ি লেন্স দিয়ে শরীরের কিছু অংশ উদোম রেখে ঘুরে বেড়ায়? না, কখনোই না। তার মানে, সেটা তাদের সহজাত এবং প্রচ্ছন্ন সৌন্দর্য। তবে আমরা নারীরা কেন অন্তর্গত বুদ্ধিদীপ্ত সৌন্দর্যের চর্চা না করে সারাক্ষণ চুন-কালি মেখে ঘুরতে থাকব? একজন সুফিয়া কামাল, সেলিনা হোসেন, ইন্দিরা গান্ধী বা বেগম রোকেয়ার মতো সরল স্পর্ধার মানুষ কি আমরা পাব না? আমরা কি মুখোশের ঘেরাটোপে পড়ে নির্লজ্জভাবে ব্যবহৃত হতে থাকব? ক্ষয়িষ্ণু এই পৃথিবীতে এ প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক উত্তর আমি হয়তো কখনোই পাব না।

Partner site : online news / celebrities /  celebrity image
website design by Web School.

0 comments to “নারীরা কি সম-অধিকারের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন?”

Post a Comment