সার্ক মিডিয়া দিবস ও আঞ্চলিক সম্মেলন

,
কয়েক সপ্তাহ আগে মালদ্বীপের আদ্দু শহরে ১৭তম সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সার্ক সম্মেলনের রীতি অনুযায়ী, সম্মেলন শেষে সর্বসম্মতিতে একটি ‘ঘোষণা’ গৃহীত হয়। এবারের ‘আদ্দু ঘোষণা’র সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ছিল: গণমাধ্যমবিষয়ক একটি আঞ্চলিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, যে সম্মেলনে বছরে একটি দিন ‘মিডিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করার কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে।
খুবই প্রশংসাযোগ্য সিদ্ধান্ত। সার্ক দেশসমূহে মিডিয়ার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের সবারই এই সিদ্ধান্তে খুশি হওয়ার কথা। এবারের সার্ক সম্মেলনে যাঁদের আগ্রহে ও সহযোগিতায় এ রকম একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।
সার্কের বয়স প্রায় ২৭ বছর হতে চলেছে অথচ মিডিয়ার মতো কার্যকর ও শক্তিশালী সেক্টর সম্পর্কে এ যাব ৎ তেমন কিছু হয়নি। অবশ্য না হওয়ার চেয়ে বিলম্বে হওয়াও ভালো। তাই এই প্রস্তাবিত আঞ্চলিক সম্মেলন কীভাবে গঠনমূলক ও কার্যকর করা যায়, সে ব্যাপারে আমরা কিছু পরামর্শ দিতে পারি।
প্রথমত দেখতে হবে, ‘সার্ক মিডিয়া ডে’ কীভাবে আয়োজন করা হবে, তা নির্ধারণ করাই হবে এই আঞ্চলিক সম্মেলনের একমাত্র এজেন্ডা। কাজেই ‘মিডিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক সম্মেলন’ বলতে যা বোঝায়, এটা সে রকম কোনো সম্মেলন নয়। যে ধরনের সম্মেলনে বহু-বিষয়ক অধিবেশন হয়, বহু রকম প্রবন্ধ পাঠ হয়, এটা সে রকম কোনো সম্মেলন হবে না। এটা যেন উদ্যোক্তারা বিস্মৃত না হন।
বলাবাহুল্য, এ ধরনের সম্মেলনে শত শত ব্যক্তি অংশ নিতেও পারবে না। কারণ, এটা পলিসি নির্ধারণবিষয়ক সম্মেলন হবে। আশা করছি, এই আঞ্চলিক সম্মেলনে সার্ক দেশসমূহের নির্বাচিত সংবাদপত্রের সম্পাদক, টিভি ও রেডিও প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বার্তা সংস্থার প্রধান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের প্রধান, চলচ্চিত্রজগতের প্রতিনিধি, খ্যাতিমান কলামিস্ট, গণমাধ্যম গবেষক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা সচিব—এ ধরনের ব্যক্তিরাই আমন্ত্রিত হবেন। প্রতিবছর সার্কভুক্ত দেশে একটি ‘সার্ক মিডিয়া ডে’ উদ্যাপনের কর্মসূচির একটা কাঠামো যাঁরা রচনা করবেন। কাজটা খুব সহজ নয়। তবে যাঁদের কথা আমরা প্রস্তাব করছি, তাঁরা একটা সভায় বসলে ভালো কিছু বের করতে পারবেন, এমনটা আশা করা অনুচিত হবে না। তবে পদাধিকার বলে ছাড়া অন্য যাঁরা এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হবেন, তাঁরা যেন মৌলিক কিছু প্রস্তাব করার মতো মেধাসম্পন্ন হন, কর্তৃপক্ষকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমন্ত্রণের এই মনোনয়ন যেন দলীয় বিবেচনায় না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। এ ধরনের ‘আঞ্চলিক সম্মেলন’ এক ধরনের পরোক্ষ প্রতিযোগিতাও। কোন দেশের প্রস্তাব বেশির ভাগ সদস্য দেশ গ্রহণ করছে বা কোন দেশের প্রতিনিধিরা গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, তার একটা প্রভাব আছে বৈকি।
আগেই বলেছি, এ ধরনের আঞ্চলিক সম্মেলনে কোনো দেশের শত শত প্রতিনিধি অংশ নিতে পারেন না। অথচ একটা দেশে মিডিয়ার প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। মিডিয়ার প্রতিনিধিদের একটা বড় অংশ যাতে এই আঞ্চলিক সম্মেলনে তাঁদের মতামত তুলে ধরতে পারেন সে জন্য ‘আঞ্চলিক সম্মেলনের’ অন্তত এক মাস আগে সার্কের প্রতিটি দেশে একটি ‘পরামর্শ সভার’ আয়োজন করা যেতে পারে। প্রতিটি দেশের তথ্য মন্ত্রণালয় এর আয়োজক হবে। এ ধরনের সভায় শতাধিক প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হয়। তবে শতাধিক প্রতিনিধিকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিলে তা খুব অর্থপূর্ণ সভা হবে কি না সন্দেহ। তবে প্রত্যেক আমন্ত্রিত ব্যক্তি যাতে ‘সার্ক মিডিয়া ডে’ বিষয়ে তাঁর আইডিয়া বা চিন্তা শেয়ার করতে পারেন, সে জন্য আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর দিনব্যাপী গ্রুপভিত্তিক আলোচনার আয়োজন করা যায়।
গ্রুপগুলো এ রকম হতে পারে: ১) মিডিয়া দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, ২) সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থার কর্মসূচি, ৩) টেলিভিশন, ৪) রেডিও, ৫) চলচ্চিত্র, ৬) সার্ক মিডিয়া ডের অনুষ্ঠান কাঠামো, ব্যাপ্তি ও অংশগ্রহণকারী ইত্যাদি। ‘মিডিয়া ডে’ উপলক্ষে প্রতিটি দেশে কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া যায় ও কেন্দ্রীয়ভাবে কী কর্মসূচি নেওয়া যায়, তা গ্রুপগুলো প্রস্তাব করতে পারে। দিনের শেষে প্লেনারিতে সব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার পর প্রস্তাবগুলো নির্দিষ্ট দেশের ‘প্রস্তাব’ হিসেবে সার্ক আঞ্চলিক সম্মেলনে পেশ করা যেতে পারে। সভায় আটটি দেশের প্রস্তাব নিয়ে আবার গ্রুপভিত্তিক আলোচনার পর চূড়ান্ত কর্মসূচি প্রণয়ন করা যেতে পারে।
আমরা মনে করি, এভাবেই ‘সার্ক মিডিয়া ডে’র কাঠামো ও কর্মসূচি চূড়ান্ত করলে তার ব্যাপক অংশীদারি নিশ্চিত হবে। আঞ্চলিক সম্মেলনে যেহেতু অনেকেই অংশ নিতে পারবেন না, সেহেতু আঞ্চলিক সম্মেলনের আগে একই এজেন্ডায় একটা পরামর্শ সভার আয়োজন করে অনেকের মতামত গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
এ রকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘সার্ক মিডিয়া ডে’র কর্মসূচি প্রণয়ন করা প্রয়োজন এ জন্য যে একবার ভুল কাঠামোতে এই দিবস পালন শুরু হয়ে গেলে তা পরিবর্তন করা সহজ হয় না। ‘গতবার এ রকম হয়েছিল’—এ রকম অজুহাত দেখিয়ে অনেকেই ভুলভাবেই দিবসটি পালনের জন্য চাপ দিতে পারে। কাজেই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য কী, কীভাবে তা কার্যকরভাবে পালন করা যায় তা খুব সুচিন্তিতভাবে প্রণয়ন করতে হবে। এই উপলক্ষে প্রস্তাবিত আঞ্চলিক সম্মেলনটি তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলন যেন মিডিয়া প্রতিনিধিদের নিছক বিদেশ সফর হয়ে না দাঁড়ায় (বা অনেক সম্মেলনেই হয়ে থাকে) সেদিকে কর্তৃপক্ষের সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার। আঞ্চলিক সম্মেলনের আগে প্রতিটি দেশে একই এজেন্ডার ‘পরামর্শ সভা’ আয়োজন করা সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পরামর্শ সভা থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব আঞ্চলিক সম্মেলনে নেওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হবে।
‘সার্ক মিডিয়া ডে’র কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াটি আরও একটি বিশেষ কারণে প্রয়োজন। তা হলো সার্কের অন্যান্য সেক্টর একটি সীমিত গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেমন: কৃষি নিয়ে সার্ক কিছু কাজ করলে তা সার্ক আঞ্চলের সব মানুষ বিস্তারিত জানতে পারেন না। শুধু কৃষি সেক্টরে যাঁরা জড়িত, তাঁরাই জানতে পারেন। কিন্তু ‘মিডিয়া’ এমন একটি সেক্টর, যা সার্ক অঞ্চলের সব মানুষকে স্পর্শ করে। মানুষ কোনো না কোনো মিডিয়ার সংস্পর্শে আসেনই। মিডিয়া দ্বারা প্রভাবিত হন না বা অবহিত হন না, এমন ব্যক্তির সংখ্যা খুব কম। কাজেই সার্ক অঞ্চলের ‘মিডিয়া’ সার্ক অঞ্চলের মানুষদের উন্নয়নের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এতে সার্ক অঞ্চলের সব মানুষকে তথ্য দেওয়া বা প্রভাবিত করা সম্ভব হবে। কাজেই ‘সার্ক মিডিয়া ডে’ অন্য ১০টি ‘দিবসের’ মতো গতানুগতিক, শুধু টি শার্ট পরে রাস্তায় হাঁটার মতো আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত রাখার দিবস হবে না। এই দিবসের তা ৎ পর্য ও কার্যকারিতা অনেক বিরাট। যদি না আটটি দেশের মিডিয়া নেতারা ও তথ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টির বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও সম্ভাবনাটা উপলব্ধি করতে পারে।
আমাদের দেশে কোনো ‘দিবস’ পালন বড় ঘটনা নয়। (জাতীয় দিবস নয়) এসব দিবস কখন আসে, কখন যায়, অনেকে জানেও না। শুধু মন্ত্রণালয় ও সরকারি কয়েকটি অফিস ‘দিবসটির’ বরাদ্দকৃত বাজেট ব্যয় করে থাকে। এর বেশি গুরুত্ব কোনো দিবসই সৃষ্টি করতে পারেনি। ‘সার্ক মিডিয়া ডে’ যেন সে রকম কোনো ‘দিবস’ না হয়।
সার্ক অঞ্চলের সাংবাদিকদের নিয়ে অতীতে একটা ‘ফোরাম’ গঠিত হয়েছে। সেই ফোরামের উদ্যোগে নানা দেশে সেমিনারও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু ফোরামটি ‘সেমিনার’ ছাড়া আর কী কাজ করেছে, তা আমার জানা নেই। অন্তত প্রচারিত হতে দেখিনি। সেই ফোরামের কাঠামো, সদস্য হওয়ার নিয়ম, কমিটি গঠন পদ্ধতি, সেমিনারের আউটপুট, সার্ক সম্মেলনে সেই ফোরামের ভূমিকাসহ নানা বিষয় সবাইকে জানানো প্রয়োজন। সার্ক দেশের সাংবাদিকদের এই ফোরামও অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। যদি তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিষ্কার থাকে। আমাদের সন্দেহ হয়, এই ফোরাম নানা সংকীর্ণ কারণে তার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। মিডিয়াবিষয়ক সার্ক আঞ্চলিক সম্মেলন ও প্রস্তাবিত সার্ক মিডিয়া ডের কর্মসূচি প্রণয়নে এই ফোরামের অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগানো যায়।
আমরা গভীর প্রত্যাশা ও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব মিডিয়াবিষয়ক সার্কের আঞ্চলিক সম্মেলন ও প্রস্তাবিত ‘সার্ক মিডিয়া ডে’র প্রতি। এই আঞ্চলিক সম্মেলন যেন প্রস্তাবিত ‘সার্ক মিডিয়া ডে’র একটা গঠনমূলক, কার্যকর ও অর্থপূর্ণ কাঠামো ও কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারে। সার্ক দেশসমূহের উন্নয়নে এই অঞ্চলের মিডিয়া আলাদাভাবে ও সম্মিলিতভাবে অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। যদি সেই ‘নেতৃত্ব’ ও ভিশন’ সার্ক অঞ্চলের মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচন করতে পারে। শুধু রাজনীতি বা সরকারেই নয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বা ফোরামেও নেতৃত্বের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।

Partner site : online news / celebrities /  celebrity image
website design by Web School.

0 comments to “সার্ক মিডিয়া দিবস ও আঞ্চলিক সম্মেলন”

Post a Comment