উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য কোথায় পাব

,
গত বছর একবার খোদ কৃষিমন্ত্রী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তাদের দেওয়া একটি তথ্যের ভুল হাতেনাতে ধরে বলেছিলেন, ‘ধানখেত বলতে পারে না, গরুও কথা বলতে পারে না, এ কারণেই কৃষিক্ষেত্রে তথ্য হেরফের করা সম্ভব।’ সত্যিই, তিনি সেবার চোখে আঙুল দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে তথ্য আড়াল করা, বিভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করে তথ্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার বহু উদাহরণ রয়েছে। আবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের ফারাক থাকার কারণে যাঁরা তথ্যকে পুঁজি করে বিভিন্ন কাজ করেন, তাঁরা একসময় রীতিমতো বিভ্রান্তিতে পড়েন। সময়ের প্রয়োজনে কৃষি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায়, কৃষিতে বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হওয়ায়, কৃষি সম্পর্কে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার আগ্রহ তৈরি হওয়ায় সর্বোপরি আমাদের দেশের কৃষকসমাজ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন ও শিক্ষিত হয়ে ওঠায় এখন তথ্যের প্রশ্নে আমাদের অনেক বেশি সতর্ক ও দায়িত্বশীল হওয়ার সময় এসেছে। কোনোমতে গোঁজামিল মিশিয়ে কিছু করার আর সুযোগ নেই। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। একটি স্ট্যান্ডার্ড ও গবেষণালব্ধ সঠিক তথ্য সবার কাছে যত দ্রুত পৌঁছে যেতে পারে, একইভাবে দ্রুত পৌঁছে যেতে পারে বিভ্রান্তিকর যেকোনো তথ্যও।

‘বাম্পার’ শব্দটি ব্যবহার হয় হাউজি খেলায়। এর অর্থ প্রাচুর্য। ফিল্মে ব্যবহূত ‘সুপার-ডুপার’ বাম্পারেরই নামান্তর। আমরা সাংবাদিকেরা এখন ‘কৃষি উৎপাদন বেড়ে যাওয়া’ বা ‘ভালো ফলন’কে বাম্পার ফলন উল্লেখ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু কথা হলো, এই বাম্পার ফলন দ্বারা আমরা কত ভাগ বৃদ্ধি বা ধানের কতখানি ফলনকে বোঝাব। যদি বলা হতো অমুক স্থানে চলতি বছর বোরোর ফলন ২০ শতাংশ বাড়বে, তাহলে অবশ্যই আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করতে হবে। সেটাই নিয়ম। কেবল ‘বাম্পার ফলন’ বললে যেন কোনো তথ্যই আর প্রয়োজন পড়ে না, এক জায়গায় বসে এক বাক্যেই সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু এতে কৃষকের অবস্থা সম্পর্কে নীতিনির্ধারকেরা কখনোই সঠিক ধারণা পান না। সুনির্দিষ্ট উৎপাদন হার উল্লেখ করা না হলে, সেই তথ্য কখনোই গ্রহণযোগ্য কিছু নয়। যেমন তিন জায়গায় ফলন মার খেয়ে এক জায়গায় ২০০ ভাগ ফলন বাড়ল, তাহলে কী দাঁড়াল? আমি যদি ওই বেশি উৎপাদনের জায়গাটিকে ধরেই মোট উৎপাদনকে বাম্পার বলে উল্লেখ করি, তাহলে সেই তথ্য শুধু ভুলই নয়, বড় রকমের বিভ্রান্তিকরও বটে। আমাদের দেশে এই বিভ্রান্তির চর্চা বেশ চলছে।

যাঁরা কৃষিবিষয়ক প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন, তাঁদের মাঠের প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। কোন এলাকা, কোন জমি, কোন ফসল ও কোন জাত, চাষের উদ্দেশ্য, ফসল কাটার পরিমাপ, ওজন—সব মিলিয়ে উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়, তার বিগত সময়ের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে উৎপাদন হার নির্ধারণ করতে হয়, যা বিস্তারিতভাবে উপজেলা-জেলা পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অফিসে নির্দিষ্ট তথ্য ছকে লেখা থাকে। কিন্তু এই ‘বাম্পার ফলন’-জাতীয় সংবাদ তথ্য কোনো কার্যকর ও ইতিবাচক অবদান রাখে না, এতে বরং কারও কারও ভাগ্য প্রসন্ন করে, কোনো কোনো বিভাগকে বাঁচিয়ে দেয়। বর্তমানের ডিজিটাল কৃষি, স্বাস্থ্য তথ্য যোগাযোগ ও শিক্ষিত সমাজে সংখ্যাতথ্যহীন ‘বাম্পার ফলন’-এর ব্যবহার বেড়ে চলেছে, যা কিছুতেই ঠিক নয়।

বর্তমানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘ এজেন্সি, নব্য কৃষিতথ্য সেবাদান সংস্থা প্রভৃতি বিচিত্র সব তথ্য প্রদান করছে। এদের প্রত্যেকের পদ্ধতিও হয়তো ভিন্ন, এক সূত্র আরেক সূত্র আস্থায় নিতে চায় না। যাঁরা এসব প্রস্তুত করা মুদ্রিত তথ্যের ওপর ভরসা করে কাজ করেন, তাঁরা রীতিমতো বিভ্রান্তিকে মেনে নিয়েই আরেক বিভ্রান্তির জাল বিস্তার করেন। এই বিভ্রান্তিরই একটি অংশ হলো ‘বাম্পার’ ধারা। এর বদলে যদি বাস্তব অবস্থা দেখে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয় এবং সুনির্দিষ্টভাবে বিশেষত তথ্য বা তুলনামূলক তথ্য প্রদান করা হয়, সেটাই হবে সবচেয়ে উপকারী সবার জন্য। অনেক সময় দেখা যায়, মাঠের সমস্যা সম্পর্কে ‘অজানা রোগ, পোকা সমস্যা ও কাল্পনিক বা অবাস্তব সমাধান’ ইত্যাদি উল্লেখের প্রয়াস নেওয়া হয়, যা প্রায়ই বিজ্ঞানভিত্তিক হয় না। যেমন বলা হয় ‘ভেজাল’ কীটনাশক, ‘অজ্ঞাত রোগ’। এই শব্দ বা বাক্যগুলো সব দিক দিয়েই ক্ষতিকর। অন্যদিকে, শুধু একজন বিজ্ঞানী কিংবা সম্প্রসারণ কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যকে তাঁর উদ্ধৃতিসহ প্রকাশ করে নিজের দায় এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই, বরং প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে সাংবাদিক বা লেখকের পক্ষ থেকে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। কৃষিবিষয়ক হিসাবনিকাশ মোটেও কঠিন কিছু নয়, কঠিন হলে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের সিংহভাগ কৃষিজীবী মানুষ, যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত নন, তাঁরা চুলচেরা হিসাবনিকাশ করে কৃষিকাজ করতে পারতেন না।

বিকশিত তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমরা প্রত্যাশা করি, দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কৃষির প্রতি যে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে তা মূল্যায়ন করেই সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উচিত সঠিক তথ্য পরিবেশনে আন্তরিক হওয়া, একইভাবে আমরা যারা কৃষিবিষয়ক সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, তাদেরও উচিত বাস্তবতা, তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করার স্বার্থেই মাঠের প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়া। তাহলেই অন্য সব ক্ষেত্রের মতোই কৃষিতেও তথ্যের অগ্রযাত্রা হবে দারুণ ইতিবাচক। তার ফলাফলও পাবে সমগ্র দেশবাসী।

Partner site : online news / celebritiescelebrity image
website design by Web School.
interior design

0 comments to “উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য কোথায় পাব”

Post a Comment