Tue, 21/06/2011 - 7:29pm | by Shykh.Seraj
বাজেটের মাস জুনের প্রথম দিন সরকার ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে আট টাকা
বৃদ্ধি করেছে। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ইউরিয়ার যথেচ্ছ ব্যবহার ও চোরাচালান
বন্ধের জন্য নেওয়া হয়েছে এ উদ্যোগ। তিনি বলেছেন, ভারতের চেয়ে এখানে ইউরিয়া
সারের দাম কম হওয়ায় তা চোরাচালান হয়ে যায়। ইউরিয়ার মূল্যবৃদ্ধি কৃষকদের
জন্য বড় একটি ধাক্কা। এরপর ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকিসহ কৃষির মোট
বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। উপকরণই যেখানে কৃষকের মূল চাওয়া, সেখানে প্রধান
উপকরণ সারে ১২ টাকার জায়গায় ২০ টাকা গোনা কঠিন ব্যাপার। মাঠপর্যায়ে হিসাব
কষে দেখা গেছে, ইউরিয়ার মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিঘাপ্রতি ধানের উৎপাদন খরচ
কমপক্ষে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা বেড়ে যাবে। কেজিপ্রতি ধানের উৎপাদন খরচ বাড়ছে
কমপক্ষে ৬০ পয়সা। আমাদের দেশে কৃষক এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ৩৩ শতকের
বিঘাপ্রতি ইউরিয়া ব্যবহার করছেন ৩৫ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত। এটি অন্যান্য
দেশের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু ইউরিয়ার ব্যবহার কমিয়ে আনার বিকল্প
প্রযুক্তি কেন দেশের সব কৃষকের কাছে পৌঁছাল না, সে প্রশ্ন না উঠে পারে না।
গুটি ইউরিয়া: ১৯৯৪-৯৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফার্টিলাইজার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আইএফডিসি) আনল নতুন এক বার্তা। গুঁড়ো বা দানা ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে কৃষক অনায়াসে ইউরিয়ার ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারবেন। প্রযুক্তিটির কার্যকারিতা বুঝে আমি বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে আইএফডিসির দলকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে অনুষ্ঠান করতে গেলাম কুমিল্লার নওয়া গ্রামে। অনুষ্ঠানটি প্রচারের পর বিভিন্ন মহল থেকে, এমনকি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সম্প্রসারণ বিভাগ থেকেও এক রকমের অলিখিত প্রতিবাদ আসতে থাকল। যুক্তি দেখানো হলো, কৃষক কোমর ভেঙে খেতের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুটি ইউরিয়া পুঁতবে? এটি কোনোভাবেই লাভজনক ও কল্যাণকর নয়। যদিও কৃষক তখনো ধানের চারা রোপণ করতেন কোমর ভেঙে, আজও তা-ই করেন। ঠিক এর ১২ বছর পর, ২০০৭ সালের কথা বলছি। বিশ্ববাজারে ইউরিয়ার সংকট তৈরি হয়। দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিক। কৃষক ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে এক কেজি ইউরিয়া মেলাতে পারছেন না। সে সময় আবারও গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের বার্তা নিয়ে হাজির হলাম কৃষকদের কাছে। কৃষকেরা এগিয়ে এলেন। তবে প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল, গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার যেখানে পৌঁছানোর কথা ছিল, ততদূর পৌঁছায়নি। খোঁজখবর করে দেখলাম, বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার হচ্ছে মাত্র সাত শতাংশ আবাদি এলাকায়। আউশ-আমনে ব্যবহার হচ্ছে মাত্র দুই থেকে তিন শতাংশ জমিতে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র বলছে, এবার বোরো মৌসুমে সাড়ে ছয় লাখ হেক্টর জমিতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার হয়েছে, এতে হেক্টরপ্রতি এক টন বেশি ফলন হিসাবে সর্বমোট সাড়ে পাঁচ লাখ টন বেশি ফলন হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ইউরিয়া সাশ্রয় হয়েছে ১০০ কেজি। হিসাব করে দেখা গেছে, ৩৩ শতকের বিঘায় আগে কৃষকেরা ইউরিয়া ব্যবহার করতেন ৩৫ থেকে ৫০ কেজি, যেখানে গুটি ইউরিয়া ২০ থেকে ৩০ কেজি। ফলন পাচ্ছেন বিঘাপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ মণ বেশি। কৃষকপর্যায়ে গুটি ইউরিয়ার ব্যাপক চাহিদা থাকলেও কৃষি বিভাগ এর জোগান দিতে পারছে না, যে কারণে সম্প্রসারণও ঘটছে না।
এলসিসি: এলসিসি হচ্ছে লিফ কালার চার্ট। ধানখেতে ইউরিয়া প্রয়োগের মাত্রা পরিমাপের একটি মাধ্যম। বাংলাদেশে এ প্রযুক্তিটি এসেছে ২০০৪ সালে। ২০০৪ সালে যখন আধুনিক ধান গবেষণা ও এশিয়ার দেশগুলোর এ ক্ষেত্রের অগ্রগতির খোঁজখবর নিতে ফিলিপাইনের লস ব্যানোসে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যাই, সেখানে এই লিফ কালার চার্ট ব্যবহার নিয়ে বিজ্ঞানীপর্যায়ে ব্যাপক তৎপরতা চলছিল। তাঁরা আশা করছিলেন, এ প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বল্পোন্নত ধান উৎপাদনকারী দেশগুলো অনেক বেশি এগিয়ে যেতে পারবে; অন্যদিকে ধানের উৎপাদন-ব্যয়ও কমে আসবে। ওই বছরই আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) পেট্রা প্রকল্পের মাধ্যমে ঝিনাইদহে কৃষকের খেতে এই এলসিসির ব্যবহার দেখতে যাই। কৃষকেরা ম্যাজিক প্রযুক্তি হিসেবে গ্রহণ করে এ পদ্ধতি। ইউরিয়া সাশ্রয় করতে পেরে দারুণ উপকৃত হন তাঁরা। পাতার রং মিলিয়েও চাহিদা বুঝে ইউরিয়া প্রয়োগ করে কৃষক এক বিঘা জমিতে ৫০ কেজির জায়গায় সর্বনিম্ন ১৩ কেজি ও সর্বোচ্চ ২০-২২ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করেই অন্যান্য সময়ের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি ফলন পান। পরীক্ষিত ও কার্যকর এই প্রযুক্তি নিয়েও দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের কাছে গিয়েছি। কৃষক থেকে শুরু করে কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও এর ব্যবহারের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছি। তাঁরাও উৎসাহ দেখিয়েছেন। বলেছেন, পর্যাপ্তসংখ্যক লিফ কালার চার্ট কৃষকদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হলে এ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ দ্রুতই ঘটানো সম্ভব। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারা দেশে এলসিসি ব্যবহারে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উদ্বুদ্ধকরণ, মাঠ দিবসসহ নানা কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেয়। সারা দেশে ১২ হাজার ২০০ ব্লকের সব ধানচাষিকে ৩০টি দলে ভাগ করে দুই লক্ষাধিক চাষিকে এলসিসি ব্যবহারবিষয়ক হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়। ফিলিপাইন থেকে আমদানি করে প্রায় তিন লাখ এলসিসি কৃষকপর্যায়ে বিনা মূল্যে বিতরণও করা হয়েছে। কিন্তু কৃষকপর্যায়ে এলসিসি সহজলভ্য না হওয়ায় এর সম্প্রসারণ ঘটেনি; যে কারণে ইউরিয়ার ব্যবহারও কমেনি।
ইউরিয়া স্প্রে: ইউরিয়া সারের যখন তীব্র সংকট, তখন টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শালিয়াবহ গ্রামের কৃষক আবদুল আজিজ আনারসের খেতে ব্যবহার করেন অদ্ভুত এক পদ্ধতি। ২০ লিটার পানিতে এক কেজি ইউরিয়ার তরল দ্রবণ। পাতা বেয়ে সে রস আনারসের গাছে ঢুকে দ্রুতই সবুজ করে তুলল খেত। একবার তিনি ধানের খেতেও ব্যবহার করলেন একই অভিজ্ঞতা। এক বিঘা জমিতে তিনি প্রয়োগ করেছেন তিন-চার কেজি ইউরিয়ার দ্রবণ। তাঁর দেখাদেখি আরও দু-একজন কৃষকের কাছে পৌঁছে গেল এ পদ্ধতি। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে এ বিষয়ে গবেষণা প্লটে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ করা হয়। তাঁরাও ওই পদ্ধতির পক্ষেই কথা বলেন। ঘাটাইলের ওই কৃষক এবং তাঁর দেখাদেখি যাঁরা ইউরিয়া স্প্রে শুরু করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, ইউরিয়া স্প্রে করে ভালো ফল পাওয়া যায়। এতে ইউরিয়ার ব্যবহার ১০ ভাগের এক ভাগে নামিয়ে আনা সম্ভব।
বিজ্ঞান এসেছে কৃষকের হাত ধরে। বিজ্ঞানী এসেছেন সেই জ্ঞান অর্জন করে। আজ প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান অনেক বেশি বিকশিত। তাই বলে কৃষককে গৌণ করে দেখার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে আমি দু-একটি তথ্য তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। গাছ পাতার সাহায্যে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রস্তুত করে, যা আমরা সবাই অবহিত; কিন্তু গাছ যে পাতার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের খনিজ উপাদানও সরাসরি গ্রহণ করতে পারে, তা আমরা অনেকেই অবহিত নই। গাছের পাতার মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে এখন থেকে অর্ধশত বছর আগে। ১৯৫০ সালে আমেরিকার মিশিগান ইউনিভার্সিটির উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের দুজন বিজ্ঞানী ড. এইচ বি টুকি ও এস এইচ উইটার প্রমাণ করেন, পাতার মাধ্যমে গ্রহণ করা খাদ্য উপাদান গাছের মধ্যে কীভাবে ঢুকে যায়, স্থানান্তরিত হয় ও কীভাবে মেটাবলিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করে। তাহলে কৃষক আবদুল আজিজ যে কাজটি করেছেন, তা-ও বিজ্ঞানসম্মত। এদিকে বেশ কিছুদিন আগে বিএডিসি পাবনার বীজ বিপণনের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আরিফ হোসেন খান আমাকে জানিয়েছেন, ‘ম্যাজিক গ্রোথ’ নামের একটি গ্রোথ প্রোমোটর তিনি উদ্ভাবন করেছেন। এই গবেষণা করতে গিয়ে তিনি ধানের পাতায় ইউরিয়ার স্প্রের কার্যকারিতা খুঁজে পান। ইতিমধ্যে তাঁর উদ্ভাবিত ম্যাজিক গ্রোথ লবণাক্ত মাটিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। তিনি এটিকে পরিচিত করছেন ‘তরল সার’ হিসেবে, যা স্প্রে করে প্রয়োগ করতে হয়; যা ইউরিয়া স্প্রের নামান্তর। যাঁরা ওই তরল সার ব্যবহার করেছেন, তাঁরাও এটি ব্যবহারের প্রশ্নে এককাট্টা।
ইউরিয়ার দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষক যে ক্ষতির মুখে পড়বেন, এতে সন্দেহ নেই। যদি কৃষকের ইউরিয়ার ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা যেত প্রতিটি এলাকায়, তাহলে মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা অনেক কমই লাগত। জানি না, কোন অদৃশ্য কারণে আমাদের দেশে ইউরিয়ার ব্যবহার কমানোর পদ্ধতিগুলো মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণে গতি নেই। দেশের চাহিদামাফিক ৩০ লাখ টন ইউরিয়া বাবদ কেজিতে আট টাকা বেশি হিসাবে কৃষককে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। সরকার ভর্তুকি ঘোষণা করেছে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ইউরিয়ার অতিরিক্ত দাম বাদ দিলে থাকে মাত্র দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা। কৃষকের ঘরে ভর্তুকি আসবে গত অর্থবছরের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ বা এর চেয়েও কম। তাঁরা আশা করছেন, সরকার অবশ্যই ইউরিয়া সারের দাম কমিয়ে আনবে এবং প্রযুক্তিগুলোর দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটাবে।
গুটি ইউরিয়া: ১৯৯৪-৯৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফার্টিলাইজার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আইএফডিসি) আনল নতুন এক বার্তা। গুঁড়ো বা দানা ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে কৃষক অনায়াসে ইউরিয়ার ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারবেন। প্রযুক্তিটির কার্যকারিতা বুঝে আমি বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে আইএফডিসির দলকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে অনুষ্ঠান করতে গেলাম কুমিল্লার নওয়া গ্রামে। অনুষ্ঠানটি প্রচারের পর বিভিন্ন মহল থেকে, এমনকি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সম্প্রসারণ বিভাগ থেকেও এক রকমের অলিখিত প্রতিবাদ আসতে থাকল। যুক্তি দেখানো হলো, কৃষক কোমর ভেঙে খেতের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুটি ইউরিয়া পুঁতবে? এটি কোনোভাবেই লাভজনক ও কল্যাণকর নয়। যদিও কৃষক তখনো ধানের চারা রোপণ করতেন কোমর ভেঙে, আজও তা-ই করেন। ঠিক এর ১২ বছর পর, ২০০৭ সালের কথা বলছি। বিশ্ববাজারে ইউরিয়ার সংকট তৈরি হয়। দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিক। কৃষক ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে এক কেজি ইউরিয়া মেলাতে পারছেন না। সে সময় আবারও গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের বার্তা নিয়ে হাজির হলাম কৃষকদের কাছে। কৃষকেরা এগিয়ে এলেন। তবে প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল, গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার যেখানে পৌঁছানোর কথা ছিল, ততদূর পৌঁছায়নি। খোঁজখবর করে দেখলাম, বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার হচ্ছে মাত্র সাত শতাংশ আবাদি এলাকায়। আউশ-আমনে ব্যবহার হচ্ছে মাত্র দুই থেকে তিন শতাংশ জমিতে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র বলছে, এবার বোরো মৌসুমে সাড়ে ছয় লাখ হেক্টর জমিতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার হয়েছে, এতে হেক্টরপ্রতি এক টন বেশি ফলন হিসাবে সর্বমোট সাড়ে পাঁচ লাখ টন বেশি ফলন হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ইউরিয়া সাশ্রয় হয়েছে ১০০ কেজি। হিসাব করে দেখা গেছে, ৩৩ শতকের বিঘায় আগে কৃষকেরা ইউরিয়া ব্যবহার করতেন ৩৫ থেকে ৫০ কেজি, যেখানে গুটি ইউরিয়া ২০ থেকে ৩০ কেজি। ফলন পাচ্ছেন বিঘাপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ মণ বেশি। কৃষকপর্যায়ে গুটি ইউরিয়ার ব্যাপক চাহিদা থাকলেও কৃষি বিভাগ এর জোগান দিতে পারছে না, যে কারণে সম্প্রসারণও ঘটছে না।
এলসিসি: এলসিসি হচ্ছে লিফ কালার চার্ট। ধানখেতে ইউরিয়া প্রয়োগের মাত্রা পরিমাপের একটি মাধ্যম। বাংলাদেশে এ প্রযুক্তিটি এসেছে ২০০৪ সালে। ২০০৪ সালে যখন আধুনিক ধান গবেষণা ও এশিয়ার দেশগুলোর এ ক্ষেত্রের অগ্রগতির খোঁজখবর নিতে ফিলিপাইনের লস ব্যানোসে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যাই, সেখানে এই লিফ কালার চার্ট ব্যবহার নিয়ে বিজ্ঞানীপর্যায়ে ব্যাপক তৎপরতা চলছিল। তাঁরা আশা করছিলেন, এ প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বল্পোন্নত ধান উৎপাদনকারী দেশগুলো অনেক বেশি এগিয়ে যেতে পারবে; অন্যদিকে ধানের উৎপাদন-ব্যয়ও কমে আসবে। ওই বছরই আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) পেট্রা প্রকল্পের মাধ্যমে ঝিনাইদহে কৃষকের খেতে এই এলসিসির ব্যবহার দেখতে যাই। কৃষকেরা ম্যাজিক প্রযুক্তি হিসেবে গ্রহণ করে এ পদ্ধতি। ইউরিয়া সাশ্রয় করতে পেরে দারুণ উপকৃত হন তাঁরা। পাতার রং মিলিয়েও চাহিদা বুঝে ইউরিয়া প্রয়োগ করে কৃষক এক বিঘা জমিতে ৫০ কেজির জায়গায় সর্বনিম্ন ১৩ কেজি ও সর্বোচ্চ ২০-২২ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করেই অন্যান্য সময়ের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি ফলন পান। পরীক্ষিত ও কার্যকর এই প্রযুক্তি নিয়েও দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের কাছে গিয়েছি। কৃষক থেকে শুরু করে কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও এর ব্যবহারের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছি। তাঁরাও উৎসাহ দেখিয়েছেন। বলেছেন, পর্যাপ্তসংখ্যক লিফ কালার চার্ট কৃষকদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হলে এ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ দ্রুতই ঘটানো সম্ভব। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারা দেশে এলসিসি ব্যবহারে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উদ্বুদ্ধকরণ, মাঠ দিবসসহ নানা কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেয়। সারা দেশে ১২ হাজার ২০০ ব্লকের সব ধানচাষিকে ৩০টি দলে ভাগ করে দুই লক্ষাধিক চাষিকে এলসিসি ব্যবহারবিষয়ক হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়। ফিলিপাইন থেকে আমদানি করে প্রায় তিন লাখ এলসিসি কৃষকপর্যায়ে বিনা মূল্যে বিতরণও করা হয়েছে। কিন্তু কৃষকপর্যায়ে এলসিসি সহজলভ্য না হওয়ায় এর সম্প্রসারণ ঘটেনি; যে কারণে ইউরিয়ার ব্যবহারও কমেনি।
ইউরিয়া স্প্রে: ইউরিয়া সারের যখন তীব্র সংকট, তখন টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শালিয়াবহ গ্রামের কৃষক আবদুল আজিজ আনারসের খেতে ব্যবহার করেন অদ্ভুত এক পদ্ধতি। ২০ লিটার পানিতে এক কেজি ইউরিয়ার তরল দ্রবণ। পাতা বেয়ে সে রস আনারসের গাছে ঢুকে দ্রুতই সবুজ করে তুলল খেত। একবার তিনি ধানের খেতেও ব্যবহার করলেন একই অভিজ্ঞতা। এক বিঘা জমিতে তিনি প্রয়োগ করেছেন তিন-চার কেজি ইউরিয়ার দ্রবণ। তাঁর দেখাদেখি আরও দু-একজন কৃষকের কাছে পৌঁছে গেল এ পদ্ধতি। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে এ বিষয়ে গবেষণা প্লটে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ করা হয়। তাঁরাও ওই পদ্ধতির পক্ষেই কথা বলেন। ঘাটাইলের ওই কৃষক এবং তাঁর দেখাদেখি যাঁরা ইউরিয়া স্প্রে শুরু করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, ইউরিয়া স্প্রে করে ভালো ফল পাওয়া যায়। এতে ইউরিয়ার ব্যবহার ১০ ভাগের এক ভাগে নামিয়ে আনা সম্ভব।
বিজ্ঞান এসেছে কৃষকের হাত ধরে। বিজ্ঞানী এসেছেন সেই জ্ঞান অর্জন করে। আজ প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান অনেক বেশি বিকশিত। তাই বলে কৃষককে গৌণ করে দেখার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে আমি দু-একটি তথ্য তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। গাছ পাতার সাহায্যে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রস্তুত করে, যা আমরা সবাই অবহিত; কিন্তু গাছ যে পাতার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের খনিজ উপাদানও সরাসরি গ্রহণ করতে পারে, তা আমরা অনেকেই অবহিত নই। গাছের পাতার মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে এখন থেকে অর্ধশত বছর আগে। ১৯৫০ সালে আমেরিকার মিশিগান ইউনিভার্সিটির উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের দুজন বিজ্ঞানী ড. এইচ বি টুকি ও এস এইচ উইটার প্রমাণ করেন, পাতার মাধ্যমে গ্রহণ করা খাদ্য উপাদান গাছের মধ্যে কীভাবে ঢুকে যায়, স্থানান্তরিত হয় ও কীভাবে মেটাবলিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করে। তাহলে কৃষক আবদুল আজিজ যে কাজটি করেছেন, তা-ও বিজ্ঞানসম্মত। এদিকে বেশ কিছুদিন আগে বিএডিসি পাবনার বীজ বিপণনের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আরিফ হোসেন খান আমাকে জানিয়েছেন, ‘ম্যাজিক গ্রোথ’ নামের একটি গ্রোথ প্রোমোটর তিনি উদ্ভাবন করেছেন। এই গবেষণা করতে গিয়ে তিনি ধানের পাতায় ইউরিয়ার স্প্রের কার্যকারিতা খুঁজে পান। ইতিমধ্যে তাঁর উদ্ভাবিত ম্যাজিক গ্রোথ লবণাক্ত মাটিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। তিনি এটিকে পরিচিত করছেন ‘তরল সার’ হিসেবে, যা স্প্রে করে প্রয়োগ করতে হয়; যা ইউরিয়া স্প্রের নামান্তর। যাঁরা ওই তরল সার ব্যবহার করেছেন, তাঁরাও এটি ব্যবহারের প্রশ্নে এককাট্টা।
ইউরিয়ার দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষক যে ক্ষতির মুখে পড়বেন, এতে সন্দেহ নেই। যদি কৃষকের ইউরিয়ার ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা যেত প্রতিটি এলাকায়, তাহলে মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা অনেক কমই লাগত। জানি না, কোন অদৃশ্য কারণে আমাদের দেশে ইউরিয়ার ব্যবহার কমানোর পদ্ধতিগুলো মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণে গতি নেই। দেশের চাহিদামাফিক ৩০ লাখ টন ইউরিয়া বাবদ কেজিতে আট টাকা বেশি হিসাবে কৃষককে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। সরকার ভর্তুকি ঘোষণা করেছে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ইউরিয়ার অতিরিক্ত দাম বাদ দিলে থাকে মাত্র দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা। কৃষকের ঘরে ভর্তুকি আসবে গত অর্থবছরের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ বা এর চেয়েও কম। তাঁরা আশা করছেন, সরকার অবশ্যই ইউরিয়া সারের দাম কমিয়ে আনবে এবং প্রযুক্তিগুলোর দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটাবে।