ভারতে বাংলাদেশ-ভাবনা - সাজ্জাদ শরিফ

,
 

সন্ধ্যার পর গাড়িতে চেপে দিল্লির এ রাস্তা থেকে ও রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখানে এসেছি ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের আমন্ত্রণে যাওয়া বাংলাদেশি তথ্যমাধ্যমের কয়েকজন সম্পাদক ও মুখ্য কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে। এই সময়টাতে আমাদের থাকার কথা ছিল কমনওয়েলথ গেমসের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। সরকারি অধিকর্তারা শেষ পর্যন্ত টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারেননি। তাই কর্মব্যস্ত সপ্তাহের শুরুর দিনটিতে অলস সময় কাটাচ্ছি পুরোনো দিল্লির তলপেটে এক অতিবিখ্যাত কাবাবঘরের খোঁজে। কমনওয়েলথ গেমস উপলক্ষে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে দিল্লির সব স্কুল। ভিখিরি আর হকারদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে শহর থেকে। নিরাপত্তার জন্য বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ। ঝলমল করছে প্রায় ফাঁকা দিল্লি শহর।
কমনওয়েলথ গেমস নিয়ে এখানে একই সঙ্গে উদ্দীপনা ও বিতর্কের অবধি নেই। এত বড় ক্রীড়াযজ্ঞের আয়োজন এর আগে ভারত কখনো করেনি। এর মধ্যে ভারত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে লম্বা পা ফেলে রীতিমতো দৌড়ে এগিয়ে এসেছে। কড়া নাড়ছে বিশ্বের পরাশক্তিচক্রে ঢোকার জন্য। এই কমনওয়েলথ গেমস তাদের জন্য এনে দিয়েছে দুনিয়ার সামনে নিজেদের তুলে ধরার এক অভূতপূর্ব সুযোগ।
‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ বা ‘ভারত উদয়’ প্রদর্শনের এমন যুগপ্রভাত কি সহজে মেলে! যদিও ৪ অক্টোবরের টাইম ম্যাগাজিনে কমনওয়েলথ গেমস নিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে একটা লেখা লিখেছেন জ্যোতি থোত্তাম। লিখেছেন, ‘কমনওয়েলথ গেমসের স্থানগুলোয় মাত্রাছাড়া খরচ, ঝুঁকির প্রতি অবজ্ঞা আর শিশুশ্রমের ব্যবহার নিয়ে শুধু বামঘেঁষারা নয়, ভারতের সব বড় বড় পত্রিকা আর টেলিভিশনই পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মোক্ষম সব খবর ছাপছে। হিন্দুস্তান টাইমস সম্প্রতি তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি ছেপেছে। খালি পায়ে প্রায় উদোম তিনজন নির্মাণশ্রমিক, দুজনে মিলে অপরজনের পা দুটি ধরে উল্টো করে ঝুলিয়ে নামিয়ে দিয়েছে একটি গর্তের ভেতরে। নিচে ব্যঙ্গাত্মক ক্যাপশন: ‘পরাশক্তি-যশোপ্রার্থী যখন কাজে ব্যস্ত।’
তবু নানা বৈষম্য আর অভ্যন্তরীণ বিবাদ সত্ত্বেও ভারত যে এগোচ্ছে, তার পরিসংখ্যান অগ্রাহ্য করবে কে? বিনিয়োগে, শিল্পায়নে, প্রবৃদ্ধিতে, মধ্যবিত্ত ভোক্তার বিপুল স্ফীতিতে ও বাজারের অতিকায় সম্প্রসারে এগিয়ে চলেছে ভারত। আর অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর দিকে তার তাকানোর প্রয়োজনও পড়েছে এই সময়ে সবচেয়ে বেশি। যোগাযোগের উন্নয়নে, নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে, বাজারের আওতা বাড়াতে, আঞ্চলিক মিত্র খুঁজতে ইত্যাদি নানা কারণেই তার এ প্রয়োজন; তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়তো পৃথিবীর বৃহৎ সোপানে পা রাখার আগে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের আর্থ-ভৌগোলিক অবস্থান সংহত করতে। এ কথা এখন ভারতের পক্ষে না ভেবে উপায় নেই যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো পিছিয়ে থাকলে ভারতের পক্ষেও এগিয়ে যাওয়া বড় কঠিন।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বন্ধু পি এন হাকসারের সম্মানে চণ্ডীগড়ে সেন্টার ফর রিসার্চ ইন রুরাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্টে (সিআরআরআইডি) দেওয়া এক ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একবার বলেছিলেন, ‘একটা প্রবাদ আছে যে আমরা বন্ধু বাছাই করতে পারি, কিন্তু প্রতিবেশী নয়। এ কথাটির অন্তর্নিহিত সারসত্য খুব তৃপ্তিদায়ক নয়। আমাদের বরং এটা নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে আমাদের প্রতিবেশীরা আমাদের ভালো বন্ধুও হতে পারে।...আমি প্রায়ই বলে থাকি যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের শুধু পারস্পরিক সীমান্ত ও সভ্যতার শেকড়ই নেই, আছে পারস্পরিক গন্তব্যও। কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যৎও আমাদের একই বন্ধনে বেঁধেছে।’ এ কথাটায় সত্য আছে; আছে উপলব্ধিও। কিন্তু ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে আসার আগে এই ভাষণ দেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালের নভেম্বরে। এরপর হিমালয়ের হিমবাহ গলে গঙ্গা ও পদ্মা হয়ে বহু পানি বঙ্গোপসাগরে নেমে এসেছে। মনের অনুভব ভূগোলে বাস্তবায়িত হয়নি। তাই এ মুহূর্তে কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে ভারত তার প্রতিবেশীদের যুক্ত করবে কীভাবে? আর বাংলাদেশই বা তার উন্নয়নের জন্য কীভাবে এই প্রক্রিয়ায় শামিল হতে পারে এবং তার নানা অর্থে বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারতের সহযোগিতা পেতে পারে?
আমাদের সীমিত প্রেক্ষাপট আপাতত বাংলাদেশ। আরও স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। কারণ, আমরা বাংলাদেশের সংবাদকর্মীরা এক সপ্তাহের জন্য এসেছি ভারতে, এখানকার নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে। মাত্র দুই দিনের মধ্যে আমাদের সঙ্গে ঝটিতি কথা হলো ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা, পরিকল্পনা কমিশনের উপ-সভাপতি মনটেক সিং আহ্লুওয়ালিয়া, বিদেশসচিব নিরুপমা রাওসহ বেশ কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে। এ কথা বলতেই হবে, সাধারণভাবে বাংলাদেশের ব্যাপারে সবার মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল যথেষ্ট। মানব-উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ যে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও অনেকটা এগিয়ে গেছে, মনটেক সিংয়ের কথায় তা নিয়ে প্রশংসা ঝরে পড়ছিল মুহুর্মুহু। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যে একটা আন্তরিক উষ্ণতার পর্যায় অতিক্রম করছে, ভারতের পক্ষ থেকে তার রেশও টের পাওয়া যাচ্ছিল সবখানেই। মন্ত্রী থেকে সচিব—সবাই বেশ আন্তরিক উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই বলছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ ভারত-সফর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটি নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে।
অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় সময় দিতে পেরেছিলেন অল্প, কিন্তু তা ছিল আন্তরিকতায় ভরা। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রতিধ্বনি করে তিনিও বললেন, ‘প্রতিবেশীদের পেছনে রেখে আমাদের পক্ষেও উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।’ তিনি জানালেন, সমস্ত ব্যস্ততা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাপারগুলো বিশেষভাবে দেখভাল করার জন্য মনমোহন সিং তাঁকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। কোনো সমস্যা দেখা দিলে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে কথা বলে তা মেটানোর ভরসাও তিনি দেন। তিনি বলেন, ভারতের কাছে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারগুলো যৌথভাবে স্থির করার ইচ্ছা ও আন্তরিকতা তাঁদের আছে।
ভারতের বিদেশমন্ত্রী প্রবীণ রাজনীতিবিদ এস এম কৃষ্ণা আগে করতেন রাজ্যের রাজনীতি। এখন এসেছেন কেন্দ্রে। তাই কথা বলতে একটু সময় নেন। প্রশ্নের উত্তরে একটু দূর থেকে ধীরে ধীরে কাছে আসেন। এর মধ্যে তৈরি করে নেন নিজেকে। তবে তাঁর কথায়ও আন্তরিকতার ঘাটতি থাকে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আগে ছিল ঈষদুষ্ণ, কিন্তু এখন তা টগবগ করছে। আমরা তাঁকে প্রশ্ন করি, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের আন্ত-আঞ্চলিক যোগাযোগে বাংলাদেশ তার ভূমি ব্যবহারে সম্মতি দিয়েছে, বাংলাদেশ কঠোরভাবে এমন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা নিরাপত্তার দিক থেকে ভারতকে অভূতপূর্ব স্বস্তি দিয়েছে। ভারত এর বিনিময়ে ব্যবহারিক মূল্য ছাড়াও বাংলাদেশকে কতটা রাজনৈতিক মূল্য দিতে প্রস্তুত? এস এম কৃষ্ণা বলেন, অনেক দূর পর্যন্ত। যদি কোনো ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের কিছুটা বেশি সুবিধা হয়, ততটুকু অবধি।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের জানা-অজানা উদ্যোগের দীর্ঘ এক তালিকা নিয়ে আমাদের মুখোমুখি হন ভারতের বিদেশসচিব নিরুপমা রাও। একের পর এক সেগুলো উত্থাপন করেন আমাদের সামনে। নানা কথার মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত আলোচনায় সীমান্ত প্রসঙ্গ উঠবে না, তা তো আর হয় না। ফলে অবধারিতভাবেই সীমান্ত অঞ্চলে কাঁটাতার, কারফিউ এবং বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর প্রসঙ্গ ওঠে। বিদেশসচিব বলেন, বিডিআর-বিএসএফ একটি সফল সভা হয়েছে। আরও আলাপ-আলোচনার জন্য আগামী মাসে আরেকটি তারিখ খোঁজা হচ্ছে। এর মধ্যে মণিপুরের কাছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাহাট খোলার সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। ২০ অক্টোবর থেকে সেটি চালু হলে দুই পারের মানুষই তখন বৈধ ব্যবসা করার সুযোগ পাবে। সীমান্ত-ঝঞ্ঝাট তখন অনেক কমে আসবে বলে তাঁর বিশ্বাস। তবে একই সঙ্গে তিনি এ কথাও যোগ করে দিতে ভোলেন না যে সীমান্তে বেশির ভাগ গোলাগুলির ঘটনা ঘটে রাতে, কারণ তখন সেখানে প্রধানত গরু চোলাচালান হয়।
নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বাধ্য হয়ে তখন তাদের গুলি চালাতে হয়। আমরা বলি, ভারতের প্রতি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রশ্নে এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কারণ, গুলি খেয়ে মরার আগে প্রত্যেক মানুষেরই ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।
এই অবধি এসে রাজনীতিবিদ-পরিকল্পনাবিদ ও আমলাদের মধ্যে একটি ক্ষীণ ভেদরেখা নজরে আসে। এটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে অন্য একটি প্রসঙ্গের সূত্রে মনটেক সিং আহ্লুওয়ালিয়া আর নিরুপমা রাওয়ের পৃথক মানসিকতায়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে কীভাবে সাহায্য করতে পারে ভারত? এর উত্তরে মনটেক সং ছিলেন অনেকটা মুক্ত ও উপমহাদেশবাদী। তাঁর সরল জবাব, ‘হিমাচলে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি, তোমরা এখান থেকে নাও। আর তোমরা উৎপাদন করতে পারলে পূর্ব ভারতে আমাদের দাও। এটা তো সহজ কথা।’ আর নিরুপমা রাওয়ের জবাব ছিল, বিদ্যুৎ নিয়ে তাঁরা নিজেরাই পড়ে আছেন বিরাট বিপাকে। বহু ভারতীয় এখনো রয়ে গেছে বিদ্যুৎবঞ্চিত। এ অবস্থায় তাঁরা আমাদের বিদ্যুৎ দেবেন কোত্থেকে?
প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলাদেশ-ভারত উন্নয়নের পথে কোন কোন বাধা তিনি দেখতে পান। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, সদিচ্ছার দিক থেকে কোনো শক্ত বাধা তাঁর নজরে পড়ে না। সমস্যা যা আছে তা মূলত বাস্তবায়নে। আমলাতন্ত্র কি তাহলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কখনো? হ্যাঁ, রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গি ফারাক হয়ে যায় বটে অনেক সময়, জবাব দেন ভারতের প্রভাবশালী এই মন্ত্রী। তবে এবার আশা করি সবকিছু ঠিকমতোই এগোবে, বলেন তিনি। আগামী বছর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে গেলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে দৃষ্টিগ্রাহ্য কিছু উন্নতি হবে বলে তিনি তাঁর আশাবাদ জানান।
ভারতের নীতিনির্ধারণী মহলে একটি গুঞ্জন শোনা গেল বেশ কয়েক জায়গাতেই। মনমোহন সিং নাকি সৌজন্য ভ্রমণে মোটেই উৎসাহী নন। কোনো দেশে তাঁর সফর মানেই দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো প্রস্তাব বা পরিকল্পনা। একজন তো হাতে গুনে গুনে দেখালেন, এ পর্যন্ত তিনি কোন কোন দেশে কী কী সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে গেছেন। এখন তা হলে অপেক্ষা করা যাক, আগামী বছর কোন প্রস্তাব বা সমাধান নিয়ে মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করতে আসেন; সত্যি সত্যি তিনি আমাদের মন কতটা মোহন করতে পারেন!
সাজ্জাদ শরিফ: কবি, সাংবাদিক।

Partner site : online news / celebritiescelebrity image
website design by Web School.
interior design

0 comments to “ভারতে বাংলাদেশ-ভাবনা - সাজ্জাদ শরিফ”

Post a Comment