Wed, 28/12/2011 - 12:31pm | by Tofael.Ahmed
সম্প্রতি সরকার ‘জেলা পরিষদ আইন ২০০০’-এর ৮২(১) ধারা প্রয়োগ করে তিনটি পার্বত্য জেলা (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) বাদে সারা দেশে সমতলের ৬১টি জেলা পরিষদ পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে ৬১ জন ‘প্রশাসক’ নিয়োগ করেছে। এই নিয়োগ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। এই সমালোচনাকে কোনোভাবে অসংগত ও ভিত্তিহীন বলা যাবে না। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯(১) অনুযায়ী, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান’ করাই সংবিধানের নির্দেশনা। তা ছাড়া সংবিধানের ১৫২(১)-এ ‘প্রশাসনিক একাংশে’র ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘জেলা’ সংবিধান স্বীকৃত প্রশাসনিক একাংশ। বাকি উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন পৃথক আইনবলে ঘোষিত প্রশাসনিক একাংশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আইনবলে গঠিত অন্যান্য একাংশে স্থানীয় সরকারকাঠামো থাকলেও সংবিধানে স্বীকৃত প্রশাসনিক একাংশ জেলায় বিগত ৪০ বছরেও একটি প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় শাসনকাঠামো গড়ে উঠল না। এ বিষয়ে ১৯৯২ সালে কুদরতে এলাহি পনির বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ যে রায় (ডিএলআর-৪৪) প্রদান করেন তা প্রকাশের ছয় মাসের মধ্যেই সকল প্রশাসনিক একাংশে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার বা স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির নির্দেশনা দেওয়া হয়।
কিন্তু ৪০ বছরে কোনো সরকার জেলাপর্যায়ে কার্যকর ও প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সৃষ্টির কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বাকশাল আমলে ‘জেলা গভর্নর’, পরবর্তী বিএনপি সরকারের ‘জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী’ বা সর্বশেষ এরশাদ সরকারের মনোনীত এমপি ও মনোনীত সদস্য নিয়ে গঠিত জেলা পরিষদ—কোনোটাই মূল সংবিধানের নির্দেশনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। তাই স্বাধীনতার ৪০ বছর এবং সংবিধানে ‘স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান’বিষয়ক বিধান পুনঃস্থাপনের পর বিশেষত সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও জেলাপর্যায়ে কোনো প্রতিনিধিত্বশীল শাসনকাঠামো তৈরি না করাটাই ছিল গুরুতর সংবিধান ও আদালত অবমাননা।
ইতিমধ্যে ২০০০ সালে ‘জেলা পরিষদ আইন ২০০০’ পাস করা হয়। এ আইন সর্বাংশে ত্রুটিমুক্ত নয়। এ আইনের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আমরা অনেকে তখনই লিখেছি। বিশেষত বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০০২ সালে প্রকাশিত তাঁর জেলায় জেলায় সরকার গ্রন্থে এ আইনের গঠনমূলক সমালোচনা করে জেলাপর্যায়ে স্থানীয় শাসনকাঠামো কীভাবে পুনর্গঠিত হওয়া উচিত তার একটি বিশদ রূপরেখা উপস্থাপন করেন। এ আইন পাস হওয়ার দীর্ঘ ১১ বছর পর আইনটি কার্যকর হতে যাচ্ছে এবং জেলা পরিষদ স্থাপিত হতে যাচ্ছে। জেলা পরিষদ স্থাপনের (ধারা-৩) প্রক্রিয়া শুরু হলো ওই আইনের ৮২(১) ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে। এখানেই যত বিপত্তি। কিন্তু জেলা পরিষদ এত দিন পর্যন্ত সরকার, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজ সবার কাছে যেন ছিল ইতিহাসের একটি বিস্মৃত অধ্যায়। এখন আকস্মিকভাবে ‘প্রশাসক’ নিয়োগের মাধ্যমে জেলা পরিষদ আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের পাদপ্রদীপে উঠে এল। এ আলোচনা ও বিতর্ক নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। এ আলোচনাকে আরও জোরদার করতে হবে।
ইতিমধ্যে ২০০০ সালে ‘জেলা পরিষদ আইন ২০০০’ পাস করা হয়। এ আইন সর্বাংশে ত্রুটিমুক্ত নয়। এ আইনের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আমরা অনেকে তখনই লিখেছি। বিশেষত বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০০২ সালে প্রকাশিত তাঁর জেলায় জেলায় সরকার গ্রন্থে এ আইনের গঠনমূলক সমালোচনা করে জেলাপর্যায়ে স্থানীয় শাসনকাঠামো কীভাবে পুনর্গঠিত হওয়া উচিত তার একটি বিশদ রূপরেখা উপস্থাপন করেন। এ আইন পাস হওয়ার দীর্ঘ ১১ বছর পর আইনটি কার্যকর হতে যাচ্ছে এবং জেলা পরিষদ স্থাপিত হতে যাচ্ছে। জেলা পরিষদ স্থাপনের (ধারা-৩) প্রক্রিয়া শুরু হলো ওই আইনের ৮২(১) ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে। এখানেই যত বিপত্তি। কিন্তু জেলা পরিষদ এত দিন পর্যন্ত সরকার, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজ সবার কাছে যেন ছিল ইতিহাসের একটি বিস্মৃত অধ্যায়। এখন আকস্মিকভাবে ‘প্রশাসক’ নিয়োগের মাধ্যমে জেলা পরিষদ আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের পাদপ্রদীপে উঠে এল। এ আলোচনা ও বিতর্ক নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। এ আলোচনাকে আরও জোরদার করতে হবে।
তবে এ ক্ষেত্রে সব সমালোচকের সঙ্গে একমত হয়েও বলব, প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘স্থাপিত’ হলো বা নবতর আঙ্গিকে এর কার্যক্রম শুরু হলো। তাই পরিষদ সচল করার ক্ষেত্রে এ নিয়োগ একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করল। এটি রাজনৈতিক দলীয় সরকারের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখানে গোপন ও প্রকাশ্য রাজনৈতিক কৌশলগত উদ্দেশ্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার জেলাপর্যায়ে পুনরায় অধিষ্ঠান যারা মনেপ্রাণে কামনা করেন, তাঁদেরও এ পদক্ষেপের কৌশলগত লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। তাই জেলা পরিষদকে বর্তমান সরকার নিষ্ক্রিয় অবস্থা থেকে সক্রিয়তা প্রদানের যেকোনো উদ্যোগকে কৌশলগতভাবে গ্রহণ করে তাকে ইতিবাচক দিকে বিকাশের উপযোগী কার্যক্রম নিয়ে এগোতে হবে। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তনের যে সূচনা হলো তাকে এগিয়ে নিয়ে ‘জেলা পরিষদ আইন ২০০০’-এর পূর্ণ বস্তবায়নে উদ্যোগী হতে আগ্রহী। কারণ যে ট্রেনটি ট্র্যাকে ছিল না সেটি এখন ট্র্যাকে উঠে এল, এখন একে সঠিক ট্র্যাকে গতি দিতে হবে। জেলা পরিষদে ভবন, বাংলো, বাজেট, জনবল ও অন্যান্য সম্পদ রয়েছে। রয়েছে প্রতিবছরের অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ। নেই প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামো এবং অর্থসম্পদ ব্যবহারের স্বচ্ছ নীতিমালা ও তার দায়িত্বশীল প্রয়োগ। তাই প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামো ও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রয়োগের সন্ধিক্ষণে এই প্রশাসক নিয়োগকে দেখতে চাই অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে। এই প্রশাসক নিয়োগ হোক স্বল্পকালীন, যা পূর্ণাঙ্গ জেলা পরিষদ গঠনের পথে হবে প্রথম সোপান।
দুই.
১৯৯১ সাল থেকে নবতর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে স্থানীয় সুশাসন ও সুসমন্বিত উন্নয়ন প্রচেষ্টার নানা ধ্যানধারণা সার্বিক নাগরিক আলোচনায় প্রাধান্য পেতে থাকে। তবে এসব আলোচনার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিষয়ের ব্যাপকতা, বিশ্লেষণের গভীরতা এবং বাস্তবতাবোধসম্পন্ন সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল এবং এখনো রয়েছে। স্থানীয় সরকারের আলাপ-আলোচনায় তিনটি প্রধান ধারা প্রধানত দেখা যায়: (১) স্থানীয় সরকারবিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প-অভিজ্ঞতার বাঁধাধরা মূল্যায়ন, যা মূলত আমলা, উপদেষ্টা, প্রকল্প প্রশাসন এবং প্রকল্পের উপকারভোগীদের পরস্পরের পিঠ চুলকানিমূলক আলোচনা। যেখানে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রায়ই অনুপস্থিত। (২) আর একটি নতুন ধারার আলোচনা হচ্ছে দাতা সংস্থার প্রকল্প-সাহায্যনির্ভর আধা নাগরিক সমাজ ও আধা এনজিও উদ্যোগ, যা মূলত প্রকল্পের ভাষায় সচেতনতামূলক বা অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম। (৩) তৃতীয় ধারাটি হচ্ছে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের গণমাধ্যমে তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। দুঃখজনক হলেও আমরা সবাই যে বিষয়টির জন্য সম্মিলিতভাবে দায়ী তা হচ্ছে (১) স্থানীয় সরকার, সুশাসন, মাঠপ্রশাসনের সমস্যা, স্থানীয় উন্নয়ন ও দক্ষ নাগরিকসেবা এবং বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ের ওপর আলোকিত ও বিশ্লেষণী গবেষণা এবং প্রকাশনার অভাব; (২) রাজনৈতিক দল ও সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে নীতি পর্যালোচনায় আগ্রহের ব্যাপক অভাব; (৩) স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত নেতাদের মধ্যে সুচিন্তিত, সুসমন্বিত, অব্যাহত ও ধারাবাহিক আত্মমূল্যায়নের অভাব; সর্বোপরি (৪) আধিপত্যবাদী গণতন্ত্রবিমুখ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি।
১৯৯১ সাল থেকে নবতর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে স্থানীয় সুশাসন ও সুসমন্বিত উন্নয়ন প্রচেষ্টার নানা ধ্যানধারণা সার্বিক নাগরিক আলোচনায় প্রাধান্য পেতে থাকে। তবে এসব আলোচনার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিষয়ের ব্যাপকতা, বিশ্লেষণের গভীরতা এবং বাস্তবতাবোধসম্পন্ন সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল এবং এখনো রয়েছে। স্থানীয় সরকারের আলাপ-আলোচনায় তিনটি প্রধান ধারা প্রধানত দেখা যায়: (১) স্থানীয় সরকারবিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প-অভিজ্ঞতার বাঁধাধরা মূল্যায়ন, যা মূলত আমলা, উপদেষ্টা, প্রকল্প প্রশাসন এবং প্রকল্পের উপকারভোগীদের পরস্পরের পিঠ চুলকানিমূলক আলোচনা। যেখানে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রায়ই অনুপস্থিত। (২) আর একটি নতুন ধারার আলোচনা হচ্ছে দাতা সংস্থার প্রকল্প-সাহায্যনির্ভর আধা নাগরিক সমাজ ও আধা এনজিও উদ্যোগ, যা মূলত প্রকল্পের ভাষায় সচেতনতামূলক বা অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম। (৩) তৃতীয় ধারাটি হচ্ছে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের গণমাধ্যমে তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। দুঃখজনক হলেও আমরা সবাই যে বিষয়টির জন্য সম্মিলিতভাবে দায়ী তা হচ্ছে (১) স্থানীয় সরকার, সুশাসন, মাঠপ্রশাসনের সমস্যা, স্থানীয় উন্নয়ন ও দক্ষ নাগরিকসেবা এবং বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ের ওপর আলোকিত ও বিশ্লেষণী গবেষণা এবং প্রকাশনার অভাব; (২) রাজনৈতিক দল ও সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে নীতি পর্যালোচনায় আগ্রহের ব্যাপক অভাব; (৩) স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত নেতাদের মধ্যে সুচিন্তিত, সুসমন্বিত, অব্যাহত ও ধারাবাহিক আত্মমূল্যায়নের অভাব; সর্বোপরি (৪) আধিপত্যবাদী গণতন্ত্রবিমুখ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি।
স্থানীয় শাসনকাঠামোর বিদ্যমান অবস্থা নানামুখী সংকটে বিপন্ন। এই বিপন্নতা স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের আমলা, জাতিগঠনমূলক বিভাগসহ সর্বত্র। মাঠপ্রশাসন ও স্তরভিত্তিক স্থানীয় সরকার—দুটি ক্ষেত্রই বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসংঘাতে চরম অস্থিরতা ও অচলাবস্থার শিকার। তাই স্থানীয় সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, উন্নয়ন ও সেবাব্যবস্থাসহ সামগ্রিক একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সব আলোচনাকে গঠনমুখী একটি ধারায় ধাবিত করতে হবে। বর্তমানে জেলা পরিষদ যেহেতু আলোচনার পাদপ্রদীপে, সেখানেও শুধু নির্বাচিত-অনির্বাচিত দ্বন্দ্বে আলোচনাকে সীমাবদ্ধ করা এটি অপরিণত আলোচনা। বাংলাদেশের বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন—এই চার পর্যায়ের প্রশাসনিক কাঠামোর ২০০ বছরের ঐতিহ্য এবং ভালো দৃষ্টান্তের পাশাপাশি বহু মন্দ দৃষ্টান্তও পাকাপোক্ত রূপ লাভ করেছে। আবার নামকাওয়াস্তে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলো যথা ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সঠিক ভূমিকা পালনে যথাযথ সামর্থ্য অর্জন করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনোভঙ্গিতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বা বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা শুধু লৌকিকতার পর্যায়ে। সনাতন জেলা প্রশাসনের প্রবল প্রভাব-প্রতিপতি ও ক্ষমতা জেলা পরিষদের মতোই ক্ষয়িষ্ণু, ম্রিয়মাণ ও অকার্যকর। সরকারের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের জেলাপর্যায়ে কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন। সরকারের কেন্দ্রীয় বাজেটের একটি বৃহৎ অংশ জেলাপর্যায়ের কর্মবিভাগগুলোর মাধ্যমে ব্যয় হয়। কিন্তু জেলাপর্যায়ে জেলাভিত্তিক বাস্তব সমস্যার কোনো বিশ্লেষণ এবং তার ভিত্তিতে নেই কোনো জেলাব্যাপী অগ্রাধিকারভিত্তিক পরিকল্পনাকাঠামো। জেলাপর্যায়ে আজকাল ব্যক্তি খাতে উন্নয়ন, সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের ব্যাপক প্রসার হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন সম্ভাবনা। সেসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য জেলাভিত্তিক নতুন স্বপ্ন রচনা এবং সেগুলোকে ভাষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন জেলাভিত্তিক একটি উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি (District vision)। জেলা পরিষদ জেলার নিম্নস্তরে অন্যান্য প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান যথা উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, নানা স্তরের বিশেষায়িত ও সাধারণী সরকারি বিভাগ, ব্যক্তি খাতের নানা প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজসহ সবাইকে নিয়ে জেলাভিত্তিক একটি উন্নয়ন স্বপ্ন ও জেলা দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিতে পারে। সে রকম একটি সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য নিয়ে জেলাপর্যায়ের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। জেলা পরিষদে একজন প্রশাসক নিয়োগ তার একটি ক্ষুদ্র সূচনামাত্র হতে পারে, এটিকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ স্বপ্নের একটি দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা নির্ণয় সবার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
তিন.
উপমহাদেশের প্রশাসনিক স্তরবিন্যাসের ভূখণ্ডগত বিভাজনে বিভাগ, জেলা ও থানার সৃষ্টি মূলত ব্রিটিশদের হাতে। ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭২-১৭৮৫) ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’কে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ২৩টি ভৌগোলিক বিভাজনে বিভক্ত করে ২৩টি জেলা সৃষ্টি করেন। ১৯৭২ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের’ অধীনে সৃষ্টি করেন বর্তমানের থানা ও ৪০০ দারোগার পদ। ১৮২৯ সালে পুরো বাংলাকে ছয়টি বিভাগে বিভক্ত করা হয় এবং সৃষ্টি হয় বিভাগীয় কমিশনারের পদ। এভাবে ঔপনিবেশিক শাসকেরা বিভাগ, জেলা ও থানায় একটি অতিশক্তিশালী কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের ভিত তৈরি করেন এবং তাঁকে ঔপনিবেশিক স্বার্থে সযত্নে লালনও করে যান। প্রায় ১০০ বছর এসব প্রশাসনিক স্তরের শীর্ষপদে কোনো দেশীয় কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হতো না। এসব ছিল লিখিত-অলিখিতভাবে ব্রিটিশদের সংরক্ষিত পদ ও পদবি। পরে দেশিদের নিয়োগ দেওয়া হলেও তাঁদের মনন, চিন্তন ও কর্মে বাদামি ব্রিটিশ হিসেবে গড়ে তোলা হতো। তিনটি স্তরে প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করানো হলেও জেলাই ছিল সব নির্বাহী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর’ নামে জেলার মূল কর্মকর্তার কর্মপরিধিতে ঔপনিবেশিক শাসকদের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ এবং রাজস্ব সংগ্রহের উপযোগী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই ছিল এ পদের মূল কাজ এবং তার সঙ্গে বিচার। সামাজিক উদ্যোগ ও অন্যান্য সরকারি কার্যক্রমের সমন্বয়কের দায়িত্ব সংযুক্ত করা হয়। কালক্রমে জেলার প্রধান প্রশাসক জেলার ‘নৃপতির’ মর্যাদা লাভ করেন। সরাসরি রাজকীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের জাহির করতে থাকেন। ব্রিটিশের নবসৃষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো বহুলাংশে মোগল ধারাবাহিকতার ব্রিটিশ সংস্করণ। মোগলদের ‘সরকার’ ও ‘পরগনা’র মাঝামাঝির স্থানে জেলা এবং তার নিচে স্থাপিত হয় ‘থানা’। মোগলদের ওই পর্যায়ের প্রশাসকের যে পদবি ‘ফৌজদার’ ও ‘কোতোয়াল’, তাঁদেরই স্থলাভিষিক্ত হলেন ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর’ এবং ‘দারোগা’রা। উপমহাদেশে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান বলে ১৬১৩ সালে সুরাটে ‘কুঠি’ স্থাপন করে যে শাসন-শোষণের সূচনা করে, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে তা একটি পাকাপোক্ত রূপ পায়। ইতিমধ্যে তারা তাদের বাণিজ্যিক ও আধিপত্যবাদী কর্মকাণ্ড বাংলাকে ছাড়িয়ে মুম্বাই, মাদ্রাজসহ ভারতের অন্যত্রও বিস্তারলাভ করতে থাকে। বাণিজ্যিক আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থকে মসৃণতর রাখার জন্য তারা কলকতা, মাদ্রাজ, মুম্বাই প্রভৃতি স্থানে নগর প্রশাসনে ইউরোপীয় ধাঁচে ‘নগরসভা’ গঠনে অবদান রাখে। বিশেষত ১৮৫৭ সালের প্রথম ‘স্বাধীনতা সমরে’র পর থেকে ঔপনিবেশিক প্রশাসনে জন-সম্পৃক্ততার প্রশ্নটি গুরুত্ব পেতে থাকে। তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে বিভিন্ন শাসক-প্রশাসক ও দার্শনিকদের কিছু ‘উদারনীতি’র প্রভাব ও প্রয়োগ। ১৮৭০ সালে চৌকিদারি ‘পঞ্চায়েত’, ১৮৮৫ সাল থেকে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত, ১৮৬৪ থেকে জেলা বোর্ডসহ বিভিন্ন নগরকেন্দ্রিক ‘পৌরসভা’কাঠামোর বিকাশ হতে থাকে। ১৮৮২ সালে লর্ড রিপনের ‘রেজুলেশনে’র মাধ্যমে যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের যাত্রা, সে উদ্যোগে ‘জেলা বোর্ড’ অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সড়ক, সাঁকো, শিক্ষা, পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্য, পশুচিকিৎসা, মহামারি নিয়ন্ত্রণসহ বহু কাজে ‘জেলা বোর্ড’ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। তবে ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর’ এবং জেলা পরিষদ উভয়ের মধ্যে দূরত্ব ও ঘনিষ্ঠতা দু-ই ছিল। অনেক বিষয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ছিল অপ্রতিবোধ্য বা স্বাভাবিকভাবে সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ। এ দুয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বও তাই অতিপুরাতন। পরবর্তী লেখায় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোর তুলনামূলক আলোচনা করার ইচ্ছে রাখি।
উপমহাদেশের প্রশাসনিক স্তরবিন্যাসের ভূখণ্ডগত বিভাজনে বিভাগ, জেলা ও থানার সৃষ্টি মূলত ব্রিটিশদের হাতে। ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭২-১৭৮৫) ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’কে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ২৩টি ভৌগোলিক বিভাজনে বিভক্ত করে ২৩টি জেলা সৃষ্টি করেন। ১৯৭২ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের’ অধীনে সৃষ্টি করেন বর্তমানের থানা ও ৪০০ দারোগার পদ। ১৮২৯ সালে পুরো বাংলাকে ছয়টি বিভাগে বিভক্ত করা হয় এবং সৃষ্টি হয় বিভাগীয় কমিশনারের পদ। এভাবে ঔপনিবেশিক শাসকেরা বিভাগ, জেলা ও থানায় একটি অতিশক্তিশালী কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের ভিত তৈরি করেন এবং তাঁকে ঔপনিবেশিক স্বার্থে সযত্নে লালনও করে যান। প্রায় ১০০ বছর এসব প্রশাসনিক স্তরের শীর্ষপদে কোনো দেশীয় কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হতো না। এসব ছিল লিখিত-অলিখিতভাবে ব্রিটিশদের সংরক্ষিত পদ ও পদবি। পরে দেশিদের নিয়োগ দেওয়া হলেও তাঁদের মনন, চিন্তন ও কর্মে বাদামি ব্রিটিশ হিসেবে গড়ে তোলা হতো। তিনটি স্তরে প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করানো হলেও জেলাই ছিল সব নির্বাহী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর’ নামে জেলার মূল কর্মকর্তার কর্মপরিধিতে ঔপনিবেশিক শাসকদের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ এবং রাজস্ব সংগ্রহের উপযোগী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই ছিল এ পদের মূল কাজ এবং তার সঙ্গে বিচার। সামাজিক উদ্যোগ ও অন্যান্য সরকারি কার্যক্রমের সমন্বয়কের দায়িত্ব সংযুক্ত করা হয়। কালক্রমে জেলার প্রধান প্রশাসক জেলার ‘নৃপতির’ মর্যাদা লাভ করেন। সরাসরি রাজকীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের জাহির করতে থাকেন। ব্রিটিশের নবসৃষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো বহুলাংশে মোগল ধারাবাহিকতার ব্রিটিশ সংস্করণ। মোগলদের ‘সরকার’ ও ‘পরগনা’র মাঝামাঝির স্থানে জেলা এবং তার নিচে স্থাপিত হয় ‘থানা’। মোগলদের ওই পর্যায়ের প্রশাসকের যে পদবি ‘ফৌজদার’ ও ‘কোতোয়াল’, তাঁদেরই স্থলাভিষিক্ত হলেন ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর’ এবং ‘দারোগা’রা। উপমহাদেশে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান বলে ১৬১৩ সালে সুরাটে ‘কুঠি’ স্থাপন করে যে শাসন-শোষণের সূচনা করে, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে তা একটি পাকাপোক্ত রূপ পায়। ইতিমধ্যে তারা তাদের বাণিজ্যিক ও আধিপত্যবাদী কর্মকাণ্ড বাংলাকে ছাড়িয়ে মুম্বাই, মাদ্রাজসহ ভারতের অন্যত্রও বিস্তারলাভ করতে থাকে। বাণিজ্যিক আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থকে মসৃণতর রাখার জন্য তারা কলকতা, মাদ্রাজ, মুম্বাই প্রভৃতি স্থানে নগর প্রশাসনে ইউরোপীয় ধাঁচে ‘নগরসভা’ গঠনে অবদান রাখে। বিশেষত ১৮৫৭ সালের প্রথম ‘স্বাধীনতা সমরে’র পর থেকে ঔপনিবেশিক প্রশাসনে জন-সম্পৃক্ততার প্রশ্নটি গুরুত্ব পেতে থাকে। তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে বিভিন্ন শাসক-প্রশাসক ও দার্শনিকদের কিছু ‘উদারনীতি’র প্রভাব ও প্রয়োগ। ১৮৭০ সালে চৌকিদারি ‘পঞ্চায়েত’, ১৮৮৫ সাল থেকে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত, ১৮৬৪ থেকে জেলা বোর্ডসহ বিভিন্ন নগরকেন্দ্রিক ‘পৌরসভা’কাঠামোর বিকাশ হতে থাকে। ১৮৮২ সালে লর্ড রিপনের ‘রেজুলেশনে’র মাধ্যমে যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের যাত্রা, সে উদ্যোগে ‘জেলা বোর্ড’ অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সড়ক, সাঁকো, শিক্ষা, পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্য, পশুচিকিৎসা, মহামারি নিয়ন্ত্রণসহ বহু কাজে ‘জেলা বোর্ড’ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। তবে ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর’ এবং জেলা পরিষদ উভয়ের মধ্যে দূরত্ব ও ঘনিষ্ঠতা দু-ই ছিল। অনেক বিষয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ছিল অপ্রতিবোধ্য বা স্বাভাবিকভাবে সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ। এ দুয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বও তাই অতিপুরাতন। পরবর্তী লেখায় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোর তুলনামূলক আলোচনা করার ইচ্ছে রাখি।