প্রয়াত শিল্পী কামরুল হাসান পাকিস্তানী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মুখের যে বিখ্যাত ড্রাকুলা ছবিটি এঁকে ইয়াহিয়া খান-এর চেহারার একটা ব্র্যান্ড আমাদের কাছে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তেমনি, ’বুদ্ধিজীবি’ নামটা শুনলেও আমার কাছে এখন সেই রকম একটা ’ব্র্যান্ড’ চেহারা ফুটে ওঠে- চাদর গায়ে দেওয়া, কুঁজো হয়ে থাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি সহ শীর্ন দেহের ভীতু এবং আত্মবিশ্বাসহীন চরিত্রের একজন হতদরিদ্র মানুষ, যিনি একটু দয়া ভিক্ষা করছেন- এই রকম একটা মানব মূর্তি। ’বুদ্ধিজীবি’ শব্দের কোন সুনির্দিষ্ট সংগা আমি কোথাও পাই নি বা ’বুদ্ধিজীবি’ দেখতে কেমন দেখায়- সেই চেহারাও আমি দেখি নি। সন্ধি-বিচ্ছেদ করলে এবং সমাস দ্বারা বিশ্লেষন করলে ’বুদ্ধিজীবি’ শব্দের অর্থ অনেকটা এই রকম দাঁড়ায়- বুদ্ধি বেচে বা বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই হিসেবে-তো সমাজের জুতাচোর-পকেটমার থেকে শুরু করে একেবারে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত- সবাই বুদ্ধিজীবি; কারন, সবাই বুদ্ধি খাটিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু তার পরও আমাদের দেশে ’বুদ্ধিজীবি’ খেতাব পেতে হলে কয়েকটা কমন বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে-
১. ইনিয়ে বিনিয়ে যেভাবেই হোক, আওয়ামী লীগ আর ভারতের মতামত এবং কাজের স্বপক্ষে কথা বলতে হবে।
২. বাঙ্গালী সংস্কৃতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতার গীত গাইতে গিয়ে শুধুমাত্র ইসলামের অনুশাসন এবং ইসলামী মূল্যবোধ-এর বিপক্ষে কথা বলতে হবে- হিন্দু, খ্রীস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মের কোন সমালোচনা করা যাবে না।
৩. সব সময় রাজাকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে এবং যত ভাবে পারা যায়, রাজাকারদের সাথে ইসলাম-কে ট্যাগ করে ফেলে রাজাকারদের অপকর্মগুলোকে ইসলামের অপকর্ম হিসেবে দেখাতে হবে।
৪. আওয়ামী লীগ বা ভারতের কোন সমালোচনা করা যাবে না- কোন বিষয়ে জনমত যদি ব্যপক ভাবে আওয়ামী লীগ এবং ভারতের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে সেই ব্যপারে চুপচাপ ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে হবে- কোন কথা বলা যাবে না।
৫. সুযোগ পেলেই শেখ মুজিব-কে প্রশংসা করতে করতে সপ্তাসমানে তুলে ফেলতে হবে এবং এই বিশ্ব সংসারের যাবতীয় ভালো কাজই যে শেখ মুজিবের স্বপ্ন ছিলো- সেটা বলে যেতে হবে; এমন কি নিউটনের তৃতীয় সূত্র আবিষ্কারে শেখ মুজিবের অবদান এবং ’এপল’ আইপ্যাডও যে শেখ মুজিবের স্বপ্ন থেকে করা হয়েছে- সেগুলোও প্রচার করতে হবে।
৬. কোন ভাবেই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে যা ঘটেছে এবং শেখ মুজিব যা করেছেন- তার কোন ইতিহাস বা উদাহরন টানা যাবে না- ইতিহাস থেকে সেই সময়টুকু একেবারে ডিলিট করে দিতে হবে। কিন্তু এর আগের এবং পরের সুবিধামত ইতিহাস টানা যাবে।
৭. শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই এই সব ’বুদ্ধিজীবি’দেরকে বর্ষাকালের কোলা ব্যাঙ-এর মতো গর্ত থেকে বের হয়ে দল বেঁধে ’কেঁ-কোঁ’ ’কেঁ-কোঁ’ শব্দে ডাকতে দেখা যায়; অন্য সরকার ক্ষমতায় থাকলে এদের আর দেখা যায় না, এদের কোন ’কেঁ-কোঁ’ শব্দও শোনা যায় না।
এবার মিলিয়ে দেখুন-
টিপাইমুখ বাঁধের ফলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত ক্ষতির সম্ভাবনা, ফারাক্কা এবং তিস্তা বাঁধের কারনে বাংলাদেশের আধা মরুকরন অবস্থা, বর্ডারে প্রায় প্রতিদিন বিএসএফ-এর গুলি করে বাংলাদেশী হত্যা, বাংলাদেশের উপর ভারতের সম্পূর্ন বিনা পয়সার ট্রানজিট সুবিধাপ্রাপ্তি চাপিয়ে দেওয়া, ছাত্রলীগ-এর প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মারামারি, চাঁদাবাজী এবং টেন্ডারবাজী, আওয়ামী লীগ-এর মাত্র তিন বছর শাসনের ভীতরই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম প্রায় তিন গুন বেড়ে যাওয়া, সরকারী ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনগন-কে ধোকা দিয়ে শেয়ার মার্কেট থেকে সরকারের লোকজনদের প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা ডাকাতি করে নিয়ে যাওয়া, সমস্ত সরকারী চাকুরী ১০০% আওয়ামীকরন করে ফেলা, ভারতের ফেনসিডিল কি ভাবে আমাদের যুবসমাজ-কে ধ্বংস করে দিচ্ছে - দেশের জনগনের এই সব জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে মুনতাসির মামুন, আগাচৌ বা শাহরিয়ার কবিরদের মতো ’বুদ্ধিজীবি’দের কোন রকম প্রতিবাদ বা উৎকন্ঠামূলক লেখা বা বক্তব্যের কথা কি আপনি জানেন? না, অবশ্যই তা জানেন না। কারন, ওরা এই বিষয়গুলো নিয়ে কখনোই কিছু বলবে না; শততা আর দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে সরকারী খরচে আনন্দ ভ্রমন আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নষ্ট করার মতো বুদ্ধিহীন আমাদের ’বুদ্ধিজীবি’রা নন।
কিন্তু রাজাকারদের বিচারের যৌক্তিকতা, ’ইসলাম কি ভাবে নারীদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে’, কেনো সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ’ইসলাম’ এবং ’বিসমিল্লাহ’ ডিলিট করা একান্তই অপরিহার্য, ’কি ভাবে জিয়াউর রহমান শেখ মুজিব হত্যার পরিকল্পনা করেছিলো’, ডঃ ইউনুস-এর নোবেল পুরুষ্কার পাওয়া কেনো উচিত হয় নি, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের স্বায়ত্বশাসন প্রদান কেনো আবশ্যক, ’শান্তি’-তে শেখ হাসিনার নোবেল পুরুষ্কার পাওয়ার চুড়ান্ত যোগ্যতা থাকার যুক্তি- এই সব নিয়ে কথা বলতে বলতে আমাদের ’বুদ্ধিজীবি’দের মুখের থুথুতে সামনের সবকিছু ভিজে যায়- যেগুলো নিয়ে সাধারন জনগনের কোন রকম স্বার্থ বা মাথা ব্যথা নেই এবং যেগুলো দিয়ে জনগনের জ্বলন্ত কোন সমস্যারই সমাধান বা কষ্ট লাঘব হয় না।
এই হলো আমাদের ’বুদ্ধিজীবি’দের চেহারা এবং চরিত্র। হয়তো আমাদের দেশের তথাকথিত ’বুদ্ধিজীবি’ নামক এই অথর্ব মানুষগুলোর কথাবার্তা আর চরিত্র দেখতে দেখতে আমার মনে কামরুল হাসানের ’জল্লাদ’ চেহারার ইয়াহিয়ার মুখের মতো ’বুদ্ধিজীবি’-দেরও সেই রকম একটা চেহারা আঁকা হয়ে গেছে। আমাদের ’বুদ্ধিজীবি’-দের এই রকম ’বুদ্ধিজীবিকা’র কারনে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের যে পরিমান ক্ষতি হচ্ছে সেটা হিসেব করলে এদেরকে ’বুদ্ধিজীবি’ বলা উচিত, নাকি ’ভ্রষ্টজীবি’ বলা উচিত, নাকি ’বিষ্ঠাজীবি’ বলা উচিত- সেসব নিয়ে হয়তো অনেক তর্ক-বিতর্কের সুযোগ রয়েছে।