নারীরা একটু একটু করে আলোর মিছিলে শামিল হচ্ছে

,
ব্যক্তিগত কাজে কয়েকদিন দেশের বাইরে ছিলাম। ফিরে এসে পুরনো পত্রিকা নিয়ে বসলাম। গত ৭ দিনের পত্রিকার হেড লাইনগুলোর ওপর চোখ বুলাচ্ছিলাম। সেই একই খবর। 'নরসিংদীর পৌর মেয়রকে গুলি করে হত্যা, 'থমকে আছে মহাসড়ক।' দুর্ঘটনা ও অবরোধে যানজট দুর্ভোগ ঘরমুখী মানুষের। সড়ক দুর্ঘটনায় মা-মেয়ের মৃত্যু। 'শেয়ার বাজারে দরপতন' ইত্যাদি পুরনো সব খবর। দুই নেত্রীর পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতা। চমক লাগানো কোন সংবাদ চোখে পড়ল না। নতুন কোন খবর পাব না জেনেও ১৩ তারিখের পত্রিকা দেখতে বসলাম। প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে সেই মন খারাপ করা সব খবর। 'পুরনো শ্রমবাজার বন্ধ, নতুন খোঁজ মেলেনি' 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তিন ইউপি সদস্যসহ নিহত ৭' 'বাস ভাড়া নিয়ে মালিকদের সেই পুরনো খেলা' ইত্যাদি। শেষ পৃষ্ঠার হেড লাইনে চোখ বুলাতে গিয়েই ছোট্ট হেড লাইনে আসা একটি খবরে চোখ আটকিয়ে গেল। 'কন্যা সাহসিকা'। গত ১১ নভেম্বর শুক্রবার বরগুনার আমতলীতে এক বিয়ের আসরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ কনেকে বরের হাতে তুলে দেয়ার পালা এ সময় যৌতুক দাবি করে বসে বরপক্ষ আর এতেই বাধে বিপত্তি। ক্ষুব্ধ কনে ফারজানা তখনই বরকে তালাকের ঘোষণা দেন। খবরটা বার বার পড়ে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বার বার খবরটা পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম। যে দেশের নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো অবস্থান নাজুক। এই একবিংশ শতাব্দীতেও সমাজ এবং রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে আছে এবং বেড়ে উঠছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনো পুরুষের অধস্তন। পুরুষের যেকোন সিদ্ধান্তকে নারীকে নতমস্তকে মেনে নিতে হচ্ছে প্রায় সব ক্ষেত্রে। সেই সমাজে বাস করে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে, ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে নিজের মত প্রকাশের এমন সাহসী পদক্ষেপ কীভাবে এত অল্প বয়সে একটি মেয়ের পক্ষে নেয়া সম্ভব হলো? আমি এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম শুনলাম।
বিয়ের আসরেই নিজের স্বাধীন মত প্রকাশের 'অধিকার' এবং 'ঔদ্ধত্যকে' সমাজ কীভাবে নেবে, পরিবার আশ্রয় দেবে কি-না, আগামী দিনগুলোতে কী কী প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কোন কিছুতেই বিচলিত না হয়ে ঘৃণাভরে এ সাহসিকা কন্যা যৌতুকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।
দেখা গেছে বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ বিবাহিতা নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। আমাদের দেশে যৌতুকের কারণে এখনো বহু নারীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। এমএমসির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছরের এপ্রিল-আগস্ট সময়ে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩৩ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী। আমাদের দেশে প্রতি সেকেন্ডে একজন নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারীকে এখনো সহ্য করতে হচ্ছে, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক নারীর অবস্থান এখনো নাজুক। নির্যাতন, নিপীড়ন এবং অনেক সময় বেছে নিতে হয় আত্মহননের মতো চরম পথ। সামাজিক এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে, 'লড়াকু' এই মেয়ের সাহসিকতার প্রশংসায় নিশ্চয় বিভিন্ন নারী সংগঠন অভিনন্দন জানিয়েছে। এই প্রত্যাশা নিয়ে পরের সংখ্যার বিভিন্ন পত্রিকাগুলো খুঁজলাম। আতিপাতি করে খুঁজে কোথাও কোন নারী সংগঠনের বক্তব্য পেলাম না। হতাশ হয়ে ভাবলাম, বিভিন্ন নারী সংগঠন দক্ষিণ এশিয়া ফোরামে তাদের কর্মতৎপরতা চালাচ্ছে, নারী আন্তর্জাতিক দিবসগুলোতে নারী অধিকারে জ্বালাময়ী বক্তৃতা, মিটিং ও মিছিল করছে। অথচ এই মেয়েটি কী তার সাহসিকতার জন্য একটা অভিনন্দন পাওয়ারও যোগ্য নয়? কোন মিডিয়া বা নারী সংগঠন এ মেয়েটিকে একটু অভিনন্দন পর্যন্ত জানায়নি। মনে হয় এ সাহসিকা কন্যা সাহসদাতাদের এজেন্ডায় নেই। নারী সংগঠনগুলো ডোনারদের এজেন্ডা পূরণ করেই সময় পাচ্ছে না দেশের কোথায় কোন কোন মেয়ে পুরুষের যৌতুক লোভের বিরুদ্ধে কি বিদ্রোহ রয়েছে তার খোঁজ রাখার সময় কোথায় তাদের।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য একটি দিনকে বেছে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব কিছু কর্মসূচি পালন করেই যেন নারী সংগঠনগুলোর 'নারী নির্যাতন বিরোধী' তৎপরতা শেষ। না ভুল বললাম, কর্মসূচির ভিডিওচিত্র দাতাদের কাছে না পাঠানো পর্যন্ত নারী সংগঠনগুলোর কর্মসূচি শেষ হয় না। প্রতিদিন অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। অনেকে মনে করেন, অর্থনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় হলে নারী নির্যাতনের মাত্রা কমবে। এ সত্যতা সব ক্ষেত্রে সঠিক নয়। এর জ্বলন্ত উদাহরণ_ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা। সামাজিক এবং পারিবারিক অবস্থার কথা ভেবে স্বামীর নির্যাতন সয়ে গেছেন একজন উচ্চশিক্ষিত নারীও।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে বেশিরভাগ নারীই শুধু যে নির্যাতনকারীর শাস্তি এড়িয়ে যায় তা নয় বরং তা নীরবে সহ্যও করে যায়।
সমগ্র বিশ্বে যখন নারী ও শিশুর নিরাপত্তার জন্য এবং নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে সেখানে আমাদের দেশে নারী এবং শিশু নির্যাতন বাড়ছেই। বিশ্ব জনসংখ্যা তহবিলের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ নারী পারিবারিক অঙ্গনে পুরুষের দ্বারা নির্যাতিত হয়।
প্রতিদিনই আমাদের চারপাশে কোন না কোন নারীর ওপর মানসিক অথবা শারীরিক অত্যাচার হচ্ছেই। নারীরা যে কতভাবে নির্যাতিত হচ্ছে_ তা আমরা প্রায় প্রতিদিনের পত্রিকা থেকে কিছু হলেও জানতে পারি। যৌতুকের জন্য পুড়িয়ে মারা, ধর্ষণের পর খুন, এসিড নিক্ষেপে মুখম-ল জ্বালিয়ে দেয়া, ফতোয়ার কারণে একঘরে করে রাখা ইত্যাদি বিভিন্ন বর্বরোচিত কায়দায় নির্যাতন করা হয়। এখন নির্যাতনের আর একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। পৈশাচিক উল্লাসে ধর্ষণের ছবি ক্যামেরাবন্দী করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়।
অথচ প্রচলিত আইনানুযায়ী প্রতিটি অপরাধের শাস্তির বিধান আছে। এসিড নিক্ষেপ এবং যৌতুকের কারণে কারও মৃত্যু হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-। নানা ধরনের আইনি জটিলতার কারণে শাস্তির প্রয়োগও ঠিকমতো হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যৌতুকের জন্য যাদের পৈশাচিক আচরণের শিকার হতে হয় তারা অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। যৌতুকের কারণে বীভৎস খুনের খবর জানা যায় প্রায় প্রতিদিনের পত্রিকাগুলোতে। যৌতুক প্রথা গোটা সমাজের নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
এখনো অনেক পরিবারেই মেয়ে সন্তানকে বোঝা মনে করা হয়। ছেলে সন্তানদের জন্য যে অর্থ ব্যয় করে, মেয়ে সন্তানদের জন্য সেই অর্থ ব্যয় করতে অনেক অভিভাবককেই অনীহা প্রকাশ করতে দেখা যায়। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। এমনকি মেয়েদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা পর্যন্ত এখনো অনেক অভিভাবক মেনে নিতে পারে না। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাটাকেই জোর করে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর ব্যতিক্রমও যে আছে তার উদাহরণ হিসেবে এখানে বরগুনার সেই 'সাহসী কন্যা'র অভিভাবকদের কথা বলতেই হয়। যৌতুকের দাবিতে কনে যখন বিয়ের আসরেই ঘরভর্তি মানুষের সামনে যৌতুকলোভী বরকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মেয়ের বাবাও সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের সিদ্ধান্তকে মেনে নেন। তিনি উপস্থিত সবার সামনে বলতে দ্বিধা করেননি 'আমার শিক্ষিত মেয়ের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই মেয়ের তালাক দেয়াকে সমর্থন করছি।'
বরগুনার সেই অভিনন্দনযোগ্য অভিভাবক সবার অনুকরণীয় হতে পারেন। সমাজের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে মেয়ের মতামতকে মূল্য দিতে যে বাবা দ্বিধা করেননি।
যে সমাজে মেয়েদের এখনো ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতিতে সমাজপতিদের খড়গ নেমে আসে। মেয়েদের বোঝা মনে না করে স্বাবলম্বী করাটাই সবার আগে বিবেচিত হওয়া উচিত। নির্যাতন এবং হয়রানির ভয় নারীর সামগ্রিক গতিশীলতার পথে একটি বড় বাধা। নারীকে শৃঙ্খলিত করে রাখার প্রবণতা সেই অতীতকাল থেকেই চলে আসছে।
সেই যে হিন্দু শাস্ত্রকার মনু বলে গেছেন, নারী কুমারীকালে বাবার, যৌবনে স্বামীর ও বার্ধক্যে ছেলের তত্ত্বাবধানে থাকবে। নারী কখনো স্বাধীন থাকার উপযুক্ত নয়। সেই ধারণা থেকে অনেকেই বের হয়ে আসতে পারেনি। শুধু নারী হয়ে জন্মানোর কারণেই নারীর মেধা, যোগ্যতা, আত্মত্যাগও সমাজে স্বীকৃতি পায় না।
জাতিগত বিদ্বেষের মতোই এটি ক্ষমতার একটি নির্মাণ। নারীর প্রতি সহিংস আচরণের আর একটি কারণ সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের উত্থান। নারীকে এরা সবসময় নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং পুরুষের সেবার জন্যই নারীর সৃষ্টি। এ অপশক্তি নারীর সব রকম মানবিক অধিকারকে অস্বীকার করে।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ এবং নির্যাতন বন্ধে শুধু শাস্তি প্রয়োগই একমাত্র সমাধান নয়। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। একই সঙ্গে সম্মিলিত নারী সমাজকেও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে সব ধরনের বৈষ্যমের বিরুদ্ধে। মনে রাখতে হবে নারীকে পেছনে রেখে বা কোণঠাসা করে রেখে কোন জাতিরই উন্নতি সম্ভব নয়।
তবে আশার কথা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং প্রতিবাদ ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। নারী নির্যাতনের ঘটনার বিরুদ্ধে এক ধরনের সামাজিক প্রতিরোধও গড়ে উঠছে। মেয়েরা এখন যৌতুকের বিরুদ্ধে, ফতোয়ার বিরুদ্ধে, এমনকি ধর্ষণের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে শিখেছেন।
নিজের অধিকারের লড়াই প্রতিদিন চালিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস বা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবসই শুধু নয়, নিজেদের যোগ্যতায় নারীরা আজ বিচারব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, রাজনীতিবিদ, সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন। অন্ধকারের পথ কেটে নারীরা এখন একটু একটু করে আলোর পথের মিছিলে শামিল হতে শিখেছেন।

Partner site : online news / celebrities /  celebrity image
website design by Web School.

0 comments to “নারীরা একটু একটু করে আলোর মিছিলে শামিল হচ্ছে”

Post a Comment