Wed, 28/12/2011 - 12:10pm | by Shykh.Seraj
বাংলা। কী ছিল এই বাংলায়। কী ছিল আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে? একদিকে যার রোপিত হয়েছে সুখের বীজ, আরেক দিকে সংগ্রাম। পুরো বাংলাই গ্রাম, আর গ্রামই জনজীবনের চালক ক্ষেত্র। ক্ষেতে চলছে হাল, নদীতে জেলে ফেলছে জাল, গৃহস্থের ভিটায় মাড়াই চলছে ধানের, কলুপাড়ায় ঘানি ঘুরছে, কামারশালায় চলছে কৃষি উপকরণ তৈরির কাজ, জীবনের সব উপকরণে ভরপুর গ্রাম। এর ভেতরেও ছিল শোষণ। ব্রিটিশদের শোষণ, সামন্ত প্রভুদের শোষণ, তারপর পাকিস্তানি শোষণ। একটি সংগ্রাম শেষ করে মানুষ যখনই এগিয়ে যেত শান্তির পথে, তখনই ঘটেছে ছন্দপতন। এসেছে বিদ্রোহ। বিদ্রোহ থেকে বিদ্রোহ। শত বিদ্রোহ হয়েছে এই বাংলায়। ৫৫ বছর আগের তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতি এখনো সজীব দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে। বিদ্রোহ, বিপ্লবের পথ বেয়ে এসেছে ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রাম। কী ছিল মূলমন্ত্র? বাংলাভরা কৃষক, মজুর আর মেহনতি মানুষের কী ছিল স্বপ্নসাধ? বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রান্তিক কৃষক থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণীর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার পেছনে লক্ষ্য ছিল একটাই_স্বাধীন ভূখণ্ডে খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে থাকা। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। এইটুকু আশা নিয়েই সেদিন যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল মুক্তি সংগ্রামে।
স্বাধীন বাংলাদেশ, গুছিয়ে উঠবে স্বাধীনতার চেতনায়। সোয়া দুই শ বছরের পুঞ্জীভূত স্বপ্নে। সেটিই ছিল সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের নতুন স্বপ্নের বীজপত্র। ৪০ বছরে যা অঙ্কুর থেকে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। আজ আমাদের অর্জন অনেক। বিশ্ব দরবারে বাঙালির যে কৃতিত্ব সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। আজ কৃষিবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সবারই গর্বের কেন্দ্রবিন্দুই এটি। একাত্তর সালে আমাদের দেশের জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে সাত কোটি। ভূমির আয়তন ছিল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি। খাদ্য উৎপাদন হতো মাত্র এক কোটি টন। কেউ কেউ বলেন, ৯০ লাখ টন। কারো কারো হিসাবে এক কোটি ১০ লাখ টন। স্বাধীনতার ৪০ বছরে আবাদি জমি কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো। জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আর খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে তিন কোটি ২৫ লাখ টন। একাত্তরে আমাদের কিছু খাদ্য ঘাটতি ছিল, সে হিসাবটিও কম নয়। ২০ থেকে ৩০ লাখ টন। আজকের দিনে এসে আমাদের খাদ্য ঘাটতির হিসাবটি অনেকটাই গৌণ হয়ে উঠেছে। ২০ লাখ টনের মতো ঘাটতি আছে ঠিক; কিন্তু তা আমাদের বর্তমানের প্রচুর উৎপাদনের হিসাবের কাছে ওই হিসাবটি বড় করে দেখার মতো নয়।
এই যে বিশাল অর্জন। কিভাবে সম্ভব হয়েছে এটি, প্রশ্ন আসতেই পারে। স্বাধীন দেশের প্রথম চেতনা, প্রথম শপথের সঙ্গে মিশে ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যয়। বাংলাদেশ নামের এই পরিবারের সবার মুখে খাদ্য তুলে দিতে হবে। মাটির সঙ্গে মিশে কৃষকই কাজটি করবেন। তাঁদের সহায়তা করবে বিজ্ঞানী, সম্প্রসারক থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ। সে সময়ের যে তৎপরতা, সেখানে সবাই সক্রিয় ছিল একই চেতনায়। পল্লী আমাদের জননী, কৃষি আমাদের সূতিকাগার, কৃষক আমাদের নায়ক_বিষয়গুলো জীবন ও সংস্কৃতির সব পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ ছিল দেশের প্রতি অদম্য টানে। একই সঙ্গে ছিল সবুজ বিপ্লবের বাতাস। ১৯৬০ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী নরম্যান বোরলগ তার সহযোগী ও সঙ্গী বিজ্ঞানীদের নিয়ে সারা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের যে তাগিদ অনুভব করেছিলেন_তার সুফলই হচ্ছে সবুজ বিপ্লব, যা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। এই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই দেশে বিজ্ঞানীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত গবেষণায়। একের পর উদ্ভাবন করেছেন এক নতুন নতুন ধানের জাত, যা খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পেছনের বড় শক্তি। আর এই শক্তিকেই এগিয়ে নিতে সক্রিয় হতে হয়েছে বিএডিসিকে। কৃষিজমিকে আনতে হয়েছে সেচের আওতায়। বাড়াতে হয়েছে অবকাঠামো। ৪০ বছরে বিএডিসির অবদানের হিসাবটিও ছোট নয়। স্বাধীনতার ৪০ বছরে তারা দেশের ৬৮ শতাংশ এলাকায় পেঁৗছে দিয়েছে সেচ সুবিধা। কৃষক উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদ করতে গিয়ে সেচের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। তা পূরণ করতে নিবিড়ভাবেই কাজ করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে সারের। কৃষকের কাছে সহজে সার পেঁৗছে দিতে সরকারকেও নিতে হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। আজ বর্তমান সময়ে এটি বিপুল অঙ্কের অর্থের ভর্তুকিতে ঠেকেছে। একদিকে বেড়েছে সারের নির্ভরতা, অন্যদিকে সরকারকেও কৃষকের পক্ষে এগোতে হয়েছে কয়েক পা।
স্বাধীনতার কয়েক বছর পর থেকেই শুরু হয় গতিশীল কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম। কৃষির উন্নয়নে দিন-রাত নিজেকে নিয়োগ করেছেন একেকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী। তাঁরা হয়েছেন কৃষকের প্রকৃত বন্ধু।
তবে এ কথাও মিথ্যে নয়, কৃষক যত বেশি উপকরণের দিকে ঝুঁকেছে, উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদ করতে গিয়ে কৃষক তত বেশি পরনির্ভরশীলতার মধ্যে পড়েছে। আর যখনই উপকরণের প্রশ্ন, উপকরণের বাহুল্যের প্রশ্ন, তখনই বাণিজ্য। এভাবেই দিনের পর দিন কৃষি ধাবিত হয়েছে বাণিজ্যের দিকে। পাশাপাশি কৃষি উপকরণগুলোকে কেন্দ্র করে দিনের পর দিন প্রসার লাভ করেছে করপোরেট বাণিজ্য। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সব ধরনের বাণিজ্যের কাছে দিনের পর দিন কৃষি পরিণত হয়েছে একটি উর্বর ক্ষেত্রে। যে বাণিজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কৃষককে বারবারই পরাজিত হতে হয়েছে। আর এর পথ ধরেই একবিংশ শতকের কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়েছে আমাদের কৃষককে। প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে জমি কমছে, আর জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ। একাত্তর সালে যে কৃষক ছিলেন ৩০ বছরের তরুণ, আজ তিনি ৭০ বছরের বৃদ্ধ। বয়স বেড়েছে, সন্তান-সন্ততি বেড়েছে, ভাগ হয়ে গেছে সংসার, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে জমির আইল। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে ভূমিহীন মানুষের মিছিল। আজ অর্থনীতিবিদদের হিসাবে দেশে ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। মোট কৃষক পরিবার যেখানে দেড় কোটি থেকে এক কোটি ৮০ লাখ, সেখানে এক কোটি ভূমিহীন! পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা নতুন করে অবতারণার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
স্বাধীনতার কয়েক বছর পর থেকেই শুরু হয় গতিশীল কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম। কৃষির উন্নয়নে দিন-রাত নিজেকে নিয়োগ করেছেন একেকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী। তাঁরা হয়েছেন কৃষকের প্রকৃত বন্ধু।
তবে এ কথাও মিথ্যে নয়, কৃষক যত বেশি উপকরণের দিকে ঝুঁকেছে, উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদ করতে গিয়ে কৃষক তত বেশি পরনির্ভরশীলতার মধ্যে পড়েছে। আর যখনই উপকরণের প্রশ্ন, উপকরণের বাহুল্যের প্রশ্ন, তখনই বাণিজ্য। এভাবেই দিনের পর দিন কৃষি ধাবিত হয়েছে বাণিজ্যের দিকে। পাশাপাশি কৃষি উপকরণগুলোকে কেন্দ্র করে দিনের পর দিন প্রসার লাভ করেছে করপোরেট বাণিজ্য। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সব ধরনের বাণিজ্যের কাছে দিনের পর দিন কৃষি পরিণত হয়েছে একটি উর্বর ক্ষেত্রে। যে বাণিজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কৃষককে বারবারই পরাজিত হতে হয়েছে। আর এর পথ ধরেই একবিংশ শতকের কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়েছে আমাদের কৃষককে। প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে জমি কমছে, আর জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ। একাত্তর সালে যে কৃষক ছিলেন ৩০ বছরের তরুণ, আজ তিনি ৭০ বছরের বৃদ্ধ। বয়স বেড়েছে, সন্তান-সন্ততি বেড়েছে, ভাগ হয়ে গেছে সংসার, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে জমির আইল। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে ভূমিহীন মানুষের মিছিল। আজ অর্থনীতিবিদদের হিসাবে দেশে ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। মোট কৃষক পরিবার যেখানে দেড় কোটি থেকে এক কোটি ৮০ লাখ, সেখানে এক কোটি ভূমিহীন! পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা নতুন করে অবতারণার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
বহু সাফল্যের ভেতর আজ যে বিষয়টি খুব পরিষ্কার, তা হচ্ছে কৃষি আর কৃষকের একার হাতের মধ্যে নেই। এক চিলতে জমিতেও শস্য উৎপাদনের জন্য তাঁকে খুলতে হয় হিসাবের ফর্দ। আর এই হিসাব মেলাতে গিয়েই মুখাপেক্ষী হতে হয় সার-কীটনাশকের ডিলার, ব্যাংক, এনজিও, স্থানীয় মহাজন, ফড়িয়া_সবার। আর এভাবেই তাঁরা সবাই হাতে পেয়ে যান কৃষককে জিম্মি করার অস্ত্র। নিজ ভূমিতেই দিনের পর দিন পরবাসী হয়েছেন কৃষক। একসময়ের ভূমির মালিক হয়েছেন নিঃস্ব। প্রথমে হয়েছেন বর্গাচাষি। তারপর দিনের পর দিন হয়েছেন দিনমজুর। যখন সোনা ফলা গ্রাম আর তাঁর হাতে থাকেনি, কৃষকের মাঠে মজুরি দেওয়ার কাজটিও যখন দুর্লভ হয়ে উঠেছে, তখন বাধ্য হয়েই তিনি হয়েছেন শহরমুখো। শহরে মানুষের চাপ বাড়ছে। বাড়ছে উদ্বেগ ও দীর্ঘশ্বাস। এভাবেই পাল্টে যেতে থাকে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষিচিত্র। তার পরও জিডিপিতে কৃষির অবদান ২০ শতাংশ। বারবারই সামনে আসে সেই কথা, দেশের ১৬ কোটি মানুষ ঘরের ধানে ভাত খায়, নিজেদের উৎপাদিত সবজি খায়, জেলেদের জালে তোলা মাছ খায়, দুধ খায়, ডিম খায়, মাংস খায়। এই সব কিছুরই জোগান ওই মাঠ থেকে, কৃষি থেকে, খামার থেকে।
একাত্তর সালে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল আট লাখ টন, এখন হচ্ছে ২৬ লাখ টন। দুধ উৎপাদন হতো পাঁচ লাখ টন, এখন হচ্ছে ২৫ লাখ টন, মাংসের উৎপাদনও বেড়েছে। মুরগি আর ডিম ছিল কৃষকের ঘরে অতিথি আপ্যায়নের কোনো রকম নিদেন বা অবলম্বন। সেখান থেকে এই শিল্প আরো বিশাল এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এর সিংহভাগই ব্যক্তি উদ্যোগের সুফল। সরকারি গণমাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশন সদ্য স্বাধীন দেশে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সামনে কৃষির জাদু ও উন্নয়নের অঙ্কগুলো তুলে ধরার প্রয়াস নেয়। যেগুলো ঘর থেকে আঙিনায় টেনে এনেছে গৃহবধূকে, শিক্ষিত বেকারকে নামিয়েছে পুকুরে আর দরিদ্র পেশাজীবী ও কৃষক শ্রেণীকে শিখিয়েছে কৃষিকাজ করে টাকা বাড়ানোর উপায়। স্বনির্ভর হওয়ার কৌশল। যদি বলি, ধান উৎপাদনের পর পরই কৃষি খাতে কোন সাফল্যকে বড় করে দেখা যাবে? আমরা বলব, সবজি উৎপাদন। গত ১০ বছরে সবজিচাষের প্রাচুর্য দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে দেশব্যাপী। এর মধ্য দিয়ে আবাদি ক্ষেতে যেমন শস্য বহুমুখীকরণ ও ফসল বৈচিত্র্য এসেছে, একইভাবে পূরণ হচ্ছে দেশের পুষ্টির চাহিদা। চাহিদার কোনো শেষ নেই। তার পরও সংশ্লিষ্টদের হিসাবে দেশের মানুষের বার্ষিক এক কোটি টন সবজি চাহিদার বিপরীতে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টন সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। যেটি একসময় ছিল না বললেই চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে উৎপাদন সাফল্যের হিসাবে তার পরই আসে পোলট্রি সেক্টর। ২০ বছরে যে শিল্প শূন্য থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে, শুধু ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের অদম্য আগ্রহে। নব্বইয়ের দশক থেকে এক এক করে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৫০ লাখ মানুষ। গড়ে উঠেছে দেড় লাখ খামার। সবই ব্যক্তি উদ্যোগের সফল। যদি বলি সহায়তার কথা, তাহলে আসবে না-পাওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বার্ড ফ্লু, হ্যাচারিতে এক দিনের বাচ্চার অগি্নমূল্য, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি এই খাতের মধ্যে দিনের পর দিন হতাশা পুঞ্জীভূত করেছে। একসময় বিদেশি যেসব কম্পানি পোলট্রি শিল্পের জন্য খাদ্য ও ওষুধ বিক্রি করতে এ দেশে ঢুকেছিল, তারা এখন নিজেরাই খামারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সব মিলিয়ে সফল এই খাতটি গত কয়েক বছর রয়েছে দুর্দিনে। বছরের কোনো কোনো সময় কয়েক দিনের জন্য সুদিন হয়তো আসে; কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময়ই খামারিরা জর্জরিত থাকেন বহুবিধ সংকট ও সমস্যায়। গত ৪০ বছরে একটি সাফল্য এসেছে প্রাণিসম্পদ গবেষণায়। প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১২ বছরের টানা গবেষণার ফসল হিসেবে একটি নতুন দেশি জাত উদ্ভাবন করেছেন।
ধরা যাক প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ শিল্পের কথাই। সরকারিভাবে উদ্যোগ ছিল কৃত্রিম প্রজননের, যা স্বাধীনতার ৪০ বছরে খুব বেশি আশাব্যঞ্জক জায়গায় যেতে পারেনি। পাশ দিয়ে এগিয়ে গেছে বেসরকারি উদ্যোগ। কৃত্রিম প্রজনন, জাত উন্নয়নসহ এ-সংক্রান্ত বিভিন্নমুখী কার্যক্রমে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এগিয়েছে বহুদূর। সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে প্রাণসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উদ্যোক্তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনা দিয়েই এই খাতে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছেন; কিন্তু খামারিরা ততটা আশাবাদী নন। দুগ্ধ খামারিরা বছরের বড় একটি সময় পার করেন সংকটে। একদিকে দুধের বাজারমূল্য তাঁদের অনুকূলে নয়, অন্যদিকে নেই বাজার ও প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে একমাত্র বৃহৎ সমবায়ী প্রতিষ্ঠানও সব ক্ষেত্রে খামারিদের অনুকূলে ভূমিকা রাখতে পারেন না। তাঁদেরও রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। রয়েছে অনিয়মও।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুরুর দিকে পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। যে ত্রুটির কারণে আজও আমাদের দেশে গরুর একটি জাত উদ্ভাবন হয়নি। ঘুরে-ফিরে আমরা বলছি রেড চিটাগাং ক্যাটেল ব্রিডের কথা, যেটি আমাদের দেশেরই প্রাচীন একটি জাত। উন্নত কোনো জাত আজ পর্যন্ত আমাদের বিজ্ঞানীদের হাত দিয়ে উদ্ভাবন হয়নি। গড়ে ওঠেনি মাংস ও দুধ উৎপাদন-প্রক্রিয়াকরণ ও সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা। মৎস্য সেক্টরের হিসাবটিও ঠিক এ-রকম। প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের প্রাচুর্য কমেছে। সাগর থেকে গেছে হিসাবের বাইরে। আর গবেষণা প্রতিষ্ঠান? ৪০ বছরে না পেঁৗছাতেই নানা সীমাবদ্ধতায় পড়েছে ঝিমিয়ে। কিন্তু এগিয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগ। গোটা মৎস্য সেক্টরের বড় অংশটিই এখন ব্যক্তি উদ্যোগনির্ভর। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ২৬ লাখ টন মাছ। যার অর্ধেকেরও বেশি জোগান দিচ্ছেন ৪২ লাখ মৎস্যচাষি। বাকি আসছে প্রাকৃতিক জলাশয়, সাগরসহ অন্যান্য উৎস্য থেকে। সংশ্লিষ্টদের তাগিদ সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশি মাছের জাত। বিজ্ঞানীদের এক হিসাবে দেখা গেছে, আমাদের দেশের প্রায় ৫৪টি মাছের জাত এখন ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পেঁৗছেছে। ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে ২৫টির মতো জাত। একইভাবে সরকারি জরিপ ও সঠিক গবেষণার অভাবে সমুদ্রের মৎস্য ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে গেছে হিসাবের বাইরেই। দেশ আজ দুধে-ভাতে নেই ঠিক; কিন্তু বহু নিয়ম, অনিয়ম ও প্রত্যাশা-প্রাপ্তির দীর্ঘ ব্যবধানের ভেতর দিয়ে টিকে আছে ১৬ কোটি মানুষ। ৪০ বছরে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কুশিয়ারা, শীতলক্ষ্যা সব নদ-নদীরই গতিমুখ পরিবর্তিত হয়েছে। ভাঙনের করাল গ্রাসে চলে গেছে লাখ লাখ একর কৃষিজমি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বারবার ছিন্নভিন্ন করেছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। কৃষি পড়েছে সংকটের মুখে। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। উচ্চ ফলনশীল খাদ্য উৎপাদনের জন্য আমরা এগিয়েছি হাইব্রিডের দিকে।
অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে কৃষি পড়েছে সীমাহীন টানাপড়েনে। উপকূলীয় কৃষক চায় লবণ-সহিষ্ণু বীজ, খরাপ্রবণ অঞ্চল চায় খরা-সহিষ্ণু বীজ আর বন্যাপ্রবণ অঞ্চল চায় বন্যা-সহিষ্ণু বীজ। শুরু হয় সরকারি গবেষণা তৎপরতা। কিছু সাফল্য এসেছে এদিকেও। এসব জাতের অধিকাংশই পেঁৗছেছে কৃষকপর্যায়ে। কিন্তু কৃষকরা সব ক্ষেত্রে পারেনি তুষ্ট হতে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর কথা যদি ধরা হয়_আইলা বিধ্বস্ত ওই অঞ্চলে লবণ-সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল আমন মৌসুমের জন্য ব্রি ধান ২৩, ব্রি ধান ৪০ ও ব্রি ধান ৪১ পেঁৗছেছে। কিন্তু কৃষকরা বলছেন, অতিরিক্ত উৎপাদন খরচ ব্যয় করেও ওই জাতগুলো খুব ভালো ফলাফল দিতে পারেনি। পরে ব্রি ধান ৪৭ও পেঁৗছে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কৃষকরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্নে থেকেই স্থানীয় শতাধিক জাত সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ১৪টি লবণ-সহিষ্ণু জাত পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে দু-একটির লবণ-সহন মাত্রা উচ্চ ফলনশীল জাতগুলোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। পক্ষান্তরে উৎপাদনে খরচের বাহুল্য নেই। কৃষকরা এই জাতগুলো নিয়ে যথেষ্টই আশাবাদী। কারণ শ্যামনগর অঞ্চলে লবণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। এ অঞ্চলের কৃষকরা বেসরকারি সংগঠন বারসিকের সহায়তায় উচ্চ ফলনশীল জাতের সঙ্গে স্থানীয় লবণ-সহিষ্ণু জাতের ক্রস ব্রিডিংয়ের মতো কঠিন বিজ্ঞানসম্মত কাজেও হাত দিয়েছেন। ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার কৃষকরাও পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবিলা করা ও ধানের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার জন্য হাত দিয়েছেন ক্রস ব্রিডিংয়ের কাজে। এই কাজগুলো কৃষক করছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। জলবায়ুগত ও মানুষ সৃষ্ট কারণে দেশের অনেক স্থানেই কৃষি বিপর্যস্ত। জনজীবন পড়েছে হুমকির মুখে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণপানি আটকে চিংড়িচাষের কুফল হিসেবে মাটি ও পরিবেশে নেমে এসেছে এ বিপর্যয়। হাজার হাজার মানুষ দিশেহারা সেখানে। অন্যদিকে জলবায়ুর পরিবর্তন, সেচসহ নানা কারণে ভূগর্ভের পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে নিচে। উঠে আসছে লবণপানি। বিকশিত হয়েছে বেসরকারি খাতের তৎপরতা। এ দেশে রয়েছে সমবায়ের সমৃদ্ধ ইতিহাস, স্বাধীনতার পরও সে বাতাস প্রবাহিত হয়েছে বহুদিন। কিন্তু পরে এনজিও তৎপরতা বাড়তে থাকলে কৃষি সমবায় অনেকটাই সংকটে পড়ে। এনজিওগুলো বহুদিন ধরেই কাজ করছে। কিন্তু আশির দশক থেকে তাদের কাজের ধারা ছিল অকৃষি খাতনির্ভর, গত পাঁচ থেকে সাত বছরে বহু এনজিও তাদের কাজের পরিধি বিস্তার করে এগিয়ে এসেছে কৃষি খাতে। বৃহত্তম বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাক গড়ে তুলেছে সুবিশাল কৃষি গবেষণা ক্ষেত্র। কৃষির বিভিন্ন অংশেই দৃষ্টি দিয়ে কাজ করছে তারা। ছোট-বড় অনেক বেসরকারি সংগঠন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনুন্নত, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনগ্রসর এলাকাগুলোয় কাজের জন্য ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এই কাজ যে সার্বিক জনকল্যাণ বয়ে আনছে, তা নয়। অনেক স্থানেই সূক্ষ্ম শোষণমূলক তৎপরতাও যে চলছে না, তা বলা যাবে না।
স্বাধীনতার ৪০ বছরে সরকারি কৃষিঋণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক একটি বিষয়। বিশেষ করে বর্তমান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় আসার পর কৃষি অর্থনৈতিক খাতে কিছুটা নতুন গতি আনতে সমর্থ হয়েছে। আগে গ্রামে গ্রামে ভূমিহীন ও বর্গাচাষিদের ঋণের জন্য অবলম্বন ছিল গ্রামীণ মহাজন, জোতদার ও এনজিওগুলো। এই শ্রেণীর মাধ্যমে কৃষক যেমন উপকৃত হয়েছেন, তেমনি হয়েছেন শোষিত। ভূমিহীন বর্গাচাষির জন্য ঋণ পাওয়ার কোনো সুবিধা ছিল না। প্রথমবারের মতো সরকারি ঋণের এই সুবিধা পাওয়া শুরু করেছেন দেশের বর্গাচাষিরা। ইতিমধ্যেই সরকারের বিনিয়োগ করা পাঁচ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা ব্র্যাকের মাধ্যমে তিন লাখ বর্গাচাষির মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। দেশের ৮০ লাখ বর্গাচাষির মধ্যে তিন লাখের কাছে ঋণ পেঁৗছে দেওয়ার বিষয়টি বড় কোনো সাফল্যের কিছু নয়। তবে একটি নতুন ধারার যে সূচনা হয়েছে, এর জন্য বর্তমান সরকার, কৃষিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন।
কৃষক এগিয়েছেন কত দূর : উত্থান-পতন ছিল গত চার দশকই। একদিক এগিয়েছে তো পিছিয়েছে আরেক দিক। এই দোলাচলের ভেতর দিয়েও কৃষি এগিয়েছে। কৃষক নিশ্চিত করেছেন দেশের মানুষের মুখের খাদ্য। যেখানে দাঁড়িয়ে আজ নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব হচ্ছে, বাংলাদেশ পুরোপুরি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার একেবারে দ্বারপ্রান্তে। খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলছেন, আগামী বছরের মধ্যে দেশ খাদ্যে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সাল নাগাদ খাদ্যশস্য আমরা রপ্তানিতে যেতে পারব। ৪০ বছরের কৃষি সাফল্য যখন এই পর্যায়ে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে কৃষক এগিয়েছে কত দূর? বহু কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই তুলে ধরেছেন বড় বড় ফর্দ। ফসল উৎপাদন করে বাজারমূল্য পাচ্ছেন না, উপকরণের দাম বেড়ে গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে তাঁরা কুলিয়ে উঠছেন না_এমন কথা সবার। বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষকরা বলেছেন, যে স্বপ্নসাধ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, তার কিছু অংশও পূরণ হয়নি। কৃষকরা পাননি ন্যায্য অধিকার ও সম্মান। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কৃষির সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে কৃষক এগোতে পারেননি। দেশে স্বাধীনতার ৪০ বছরে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের আয় বৈষম্য। ১৯৯০ সালে যেখানে মানুষের খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪০০ গ্রাম। এখন এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫০ গ্রামের মতো। কিন্তু এই খাদ্য কি সব শ্রেণী পাচ্ছে? এখনো বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, অর্থনীতিবিদদের হিসাবে দেশে দরিদ্র মানুষের হার ৮০ শতাংশের কম নয়, যার সিংহভাগই কৃষক শ্রেণী। তাহলে কিভাবে বলা যাবে, কৃষক এগিয়েছেন?
কৃষক এগিয়েছেন কত দূর : উত্থান-পতন ছিল গত চার দশকই। একদিক এগিয়েছে তো পিছিয়েছে আরেক দিক। এই দোলাচলের ভেতর দিয়েও কৃষি এগিয়েছে। কৃষক নিশ্চিত করেছেন দেশের মানুষের মুখের খাদ্য। যেখানে দাঁড়িয়ে আজ নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব হচ্ছে, বাংলাদেশ পুরোপুরি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার একেবারে দ্বারপ্রান্তে। খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলছেন, আগামী বছরের মধ্যে দেশ খাদ্যে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সাল নাগাদ খাদ্যশস্য আমরা রপ্তানিতে যেতে পারব। ৪০ বছরের কৃষি সাফল্য যখন এই পর্যায়ে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে কৃষক এগিয়েছে কত দূর? বহু কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই তুলে ধরেছেন বড় বড় ফর্দ। ফসল উৎপাদন করে বাজারমূল্য পাচ্ছেন না, উপকরণের দাম বেড়ে গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে তাঁরা কুলিয়ে উঠছেন না_এমন কথা সবার। বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষকরা বলেছেন, যে স্বপ্নসাধ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, তার কিছু অংশও পূরণ হয়নি। কৃষকরা পাননি ন্যায্য অধিকার ও সম্মান। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কৃষির সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে কৃষক এগোতে পারেননি। দেশে স্বাধীনতার ৪০ বছরে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের আয় বৈষম্য। ১৯৯০ সালে যেখানে মানুষের খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪০০ গ্রাম। এখন এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫০ গ্রামের মতো। কিন্তু এই খাদ্য কি সব শ্রেণী পাচ্ছে? এখনো বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, অর্থনীতিবিদদের হিসাবে দেশে দরিদ্র মানুষের হার ৮০ শতাংশের কম নয়, যার সিংহভাগই কৃষক শ্রেণী। তাহলে কিভাবে বলা যাবে, কৃষক এগিয়েছেন?
আগামীর জন্য : একাত্তর থেকে দুই হাজার এগারো। সময়ের পালাবদলে এ দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার ভেতরও কৃষি সাফল্যের কারণেই সুস্থির থাকতে সমর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সব মিলিয়েই আমাদের সামনে এখন বড় এক চ্যালেঞ্জ। আজকে যে সাফল্যের অঙ্ক আমরা কষতে পারছি, তার কি ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হবে আগামী ১০ বছর পর, যখন এই বাংলাদেশ পেঁৗছাবে তার সুবর্ণজয়ন্তীতে? কী প্রস্তুতি আছে আমাদের? কী-ই বা করণীয়? কৃষি নিয়ে দীর্ঘ তিন যুগ কাজ করার সুবাদেই অগ্রসর-অনগ্রসর সব কৃষকের সাফল্য ও সমস্যাগুলো কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি তাঁদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও উত্থান-পতন। একই সঙ্গে বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের চিন্তা ও কাজগুলোর মধ্যেও চেষ্টা করেছি একটি সেতুবন্ধ রচনা করতে। ঠিক সেই অবস্থান থেকে আগামীর করণীয় হিসেবে যেদিকে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি দেওয়া দরকার, তা হচ্ছে_ক. পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। আর এই ঝুঁকির পুরোটাই পড়েছে কৃষির ওপর। এই দিকটিই আমাদের সবচেয়ে আগে বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের কৃষি গবেষণা, সম্প্রসারণসহ সব ক্ষেত্রকে ঢেলে সাজাতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক মাটি গবেষণা, বীজ গবেষণা ও উন্নয়ন, কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, কৃষকদের সচেতন করে তোলাসহ কৃষি কল্যাণমুখী উদ্যোগ নিতে হবে।
খ. গবেষণায় নতুন গতি সঞ্চার করতে হবে। স্বাধীনতার পরপর যে গতি ছিল বিজ্ঞানীদের মধ্যে, সেই গতি আজকের দিনে আনতে হলে অবশ্যই কৃষি গবেষণা অবকাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন। সে সঙ্গে দেশের বিজ্ঞানীদের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশে সরকারি কর্মকমিশনের নিয়ম অনুযায়ী বিজ্ঞানীদেরও অবসরে চলে যেতে হয় ৫৭ বছর বয়সে। অথচ ওই বয়সটিই একজন বিজ্ঞানীর পূর্ণতা লাভের সময়। প্রবীণ বিজ্ঞানী ড. কাজী বদরুদ্দোজা বলেছেন, দেশ বিজ্ঞানীদের পূর্ণ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেবাটি গ্রহণ করতে পারছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে কৃষিবিজ্ঞানীদের কমপক্ষে ৬৫ বছর থেকে একেবারে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সরকারি দায়িত্ব পালনের সুবিধা রয়েছে। এই সুবিধা এখানেও সৃষ্টি করতে হবে। গ. কৃষিজমি রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ। কৃষির মধ্যে শিল্প, আবাসন কিংবা অবকাঠামো নির্মাণের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
ঘ. কৃষিপণ্যের বাজার কাঠামোয় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকে বিজ্ঞানসম্মত, কার্যকর ও আধুনিক বাজার কৌশল নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কৃষক উৎপাদন খরচের সঙ্গে কোনোভাবে পুষিয়ে উঠতে না পারলে কৃষির প্রতি তাঁর আস্থা থাকবে না। বাধ্য হবেন অন্য পেশায় যেতে। এ ক্ষেত্রে অন্তত কয়েকটি কৃষিপণ্যের মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে কৃষক কখনোই লোকসানের শিকার না হন। ঙ. রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনার জায়গায় কৃষকের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। চ. কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একদিকে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, অন্যদিকে বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষির বিভিন্ন উপকরণ বাণিজ্যে নেমেছে, তাদেরও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। ছ. যেকোনো মূল্যে কৃষককে সংগঠিত করতে হবে। প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বাইরে একটি কৃষিভিত্তিক সংগঠন সবখানে গড়ে তুলতে না পারলে কৃষক কোনোভাবেই তাঁর অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।
ঘ. কৃষিপণ্যের বাজার কাঠামোয় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকে বিজ্ঞানসম্মত, কার্যকর ও আধুনিক বাজার কৌশল নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কৃষক উৎপাদন খরচের সঙ্গে কোনোভাবে পুষিয়ে উঠতে না পারলে কৃষির প্রতি তাঁর আস্থা থাকবে না। বাধ্য হবেন অন্য পেশায় যেতে। এ ক্ষেত্রে অন্তত কয়েকটি কৃষিপণ্যের মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে কৃষক কখনোই লোকসানের শিকার না হন। ঙ. রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনার জায়গায় কৃষকের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। চ. কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একদিকে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, অন্যদিকে বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষির বিভিন্ন উপকরণ বাণিজ্যে নেমেছে, তাদেরও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। ছ. যেকোনো মূল্যে কৃষককে সংগঠিত করতে হবে। প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বাইরে একটি কৃষিভিত্তিক সংগঠন সবখানে গড়ে তুলতে না পারলে কৃষক কোনোভাবেই তাঁর অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।
বিজয়ের ৪০ বছর। এই সময়ের মধ্যে আশ্চর্য সহ্যক্ষমতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি জাতি হিসেবে টিকে আছে বাঙালি। আজ এ দেশের প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশের হিসাব করছি আমরা, পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় আমাদের এই অর্জন অনেক বড়। আরো বড় অর্জনের কাছাকাছি আমরা। কিন্তু আমাদের এই কৃতিত্ব ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত উদ্যোগ। একাত্তরে যেমন সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সবার সবটুকু সাধ্য নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতার লাল সূর্য, আজও সবার সবটুকু শক্তি দিয়েই নিশ্চিত করতে হবে একটি সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যেখানে জনসংখ্যার এই আধিক্য কোনো সংকট হয়ে দেখা দেবে না; বরং জনসংখ্যা পরিণত হবে জনশক্তিতে। আর নিজস্ব উৎপাদনব্যবস্থায় আমরা থাকব স্বয়ম্ভর।