হাত বাড়াও, বন্ধু

,

মাস কয়েক আগে প্রথম আলো পত্রিকায় ময়মনসিংহের রিকশাচালক জয়নাল আবেদিনের ওপর একটি প্রতিবেদন বের হয়েছিল। হতদরিদ্র এক দিনমজুর, তিলে তিলে সঞ্চয় করে প্রায় ৩০ বছরের এক টানা সাধনার পর নিজের অর্থে গড়েছেন একটি হাসপাতাল ও একটি স্কুল। অবিশ্বাস্য ঘটনা, কিন্তু সত্যি। বিনা চিকিৎসায় বাবার মৃত্যুর পর জয়নাল শপথ করেছিলেন একটি হাসপাতাল করবেন, যেখানে তাঁর বাবার মতো হতদরিদ্র মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পাবে।
সন্দেহ নেই, জয়নাল সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রম ও একাগ্রতার ফসল এই হাসপাতাল। প্রতিবেদনটি ঘনিষ্ঠভাবে পড়লে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। একার কাজ, কিন্তু একা একা এ কাজ তিনি শেষ করেননি। বাবার মৃত্যুর পর সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন জয়নাল। শাহজাহানপুর রেল কলোনির পানির ট্যাংকের কাছে সে সময় তিনি আশ্রয় নিয়েছেন। অসহায় এই মানুষটিকে দেখে এগিয়ে আসেন স্থানীয় এক রিকশা মালিক মোশাররফ। নিজ থেকেই তাঁকে রিকশা চালানোর ব্যবস্থা করে দেন। টিকে থাকার জন্য ৫০ টাকা দেন, কী করে রিকশা চালাতে হয়, তা-ও হাতে ধরে শিখিয়ে দেন।
আরও একজন মানুষ তাঁকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। রিকশা চালিয়ে যে অল্প-বিস্তর অর্থ জমত, তা আলাদা করে রেখে দিতেন জয়নাল তাঁর স্বপ্নের হাসপাতালের জন্য। খুব চেষ্টায় ছিলেন ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে। সবাই অবজ্ঞাভরে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, বলেছে, রিকশা চালিয়ে আর কয় পয়সা জমানো যাবে। এমন সময় একজনের কাছ থেকে সাহায্যের আকস্মিক হাত এগিয়ে আসে। সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার সালেহা আক্তার তাঁকে সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে সাহায্য করেন। ২০ বছর পর তাঁর মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা। শুরু হয়ে যায় জয়নালের স্বপ্নের হাসপাতাল।
এ ঘটনাটা মাথায় রাখুন। এবার আমি আপনাদের ভিন্ন দুটি ঘটনা বলব, এর একটি মাইক্রোসফটের বিল গেটস, অন্যটি বিখ্যাত পপ গ্রুপ বিটলসকে নিয়ে। এঁদের মধ্যে সম্পর্ক কোথায়, সে কথায় পরে আসছি।
অবস্থাসম্পন্ন পিতা-মাতার সন্তান বিল গেটস বড় হয়েছেন সিয়াটলে। গোড়াতে পড়াশোনা করেছেন স্থানীয় সরকারি স্কুলে, সপ্তম শ্রেণী থেকে তাঁকে ভর্তি করানো হয় লেকসাইড নামে একটি প্রাইভেট স্কুলে। বড়লোকদের স্কুল, লেখাপড়ার বিস্তর সুযোগ সেখানে। এই স্কুলের মায়েরা মিলে একটি মাদার্স ক্লাব গড়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে এই ক্লাবের পয়সায় একটি কম্পিউটার ক্লাবের ব্যবস্থা করা হয়, গ্রীষ্মের ছুটিতে ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত রাখাই তাঁদের উদ্দেশ্য। তখনো ঘরে ঘরে কম্পিউটার আসেনি, পুরো ব্যাপারটিই নতুন। যে কম্পিউটারটি কেনা হলো, তা ছিল এএসআর-৩৩ টেলিটাইপ, যা টাইম-শেয়ারিং ব্যবস্থায় সরাসরি যুক্ত ছিল সিয়াটলের শহরতলির মেইনফ্রেম কম্পিউটারের সঙ্গে। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র বিল গেটস প্রথমবারে মতো টাইম-শেয়ার ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হলেন। তখন থেকে বলতে গেলে প্রায় সারাক্ষণই সেই কম্পিউটার রুমে পড়ে থাকতেন বিল গেটস। এর সামান্য কিছু পরে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় একটি কম্পিউটার সেন্টার খোলে। সে সেন্টারের অন্যতম পরিচালক মনিক রোনার এক ছেলে পড়ত লেকসাইডে। তিনি উদ্যোগ নিয়ে লেকসাইড স্কুলের কম্পিউটার ক্লাবের সদস্যদের বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টারের সফটওয়্যার পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন। ছাত্ররা সে সফটওয়্যারের ব্যবহার যোগ্যতা টেস্ট করবে, বিনিময় শনি-রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার কেন্দ্রে নিখরচায় প্রোগ্রামিং করার সুযোগ পাবে। লাফিয়ে উঠলেন বিল গেটস। রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে সাইকেল চালিয়ে কম্পিউটার সেন্টারে আসতেন, বাবা-মা জানতেও পারতেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে পড়ে থাকতেন। তিন বছর পরের ঘটনা। ওয়াশিংটন স্টেটের একটি বিদ্যুৎ কোম্পানি তাদের নতুন কম্পিউটার ব্যবস্থা ‘টেস্ট’ করার জন্য লোক খোঁজা শুরু করেছে। সময়টা ১৯৭১, তখনো কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বোঝে এমন লোক বেশি ছিল না। বাড পেম্বরুক নামের এক ভদ্রলোক বিল ও তাঁর বন্ধুদের কথা জানতেন। তাঁরই উদ্যোগে বিলের জন্য ব্যবস্থা হয়ে গেল নতুন সেই কম্পিউটার পরীক্ষা করার। হাইস্কুল শেষ করার আগেই হাজার হাজার ঘণ্টা—সম্ভবত ১০ হাজার ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি—কম্পিউটার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেরে ফেললেন বিল গেটস।
এবার বিটলসের গল্প
ষাটের দশকের গোড়ার দিকে লিভারপুলে চার ইংরেজ তরুণ মিলে একটি গানের দল গড়ে তোলেন। খুব বেশি লোক তাঁদের কথা জানত না, তাঁদের গান পছন্দও করত না। এ সময় ব্রুনো নামের এক জার্মান লন্ডনে আসেন হামবুর্গে তাঁর নাইট ক্লাবের জন্য গানের দল ভাড়া করতে। এক ইংরেজ বন্ধুর কাছ থেকে তিনি বিটলসের খোঁজ পেলেন, গান শুনে ভালো লাগল, তাঁদের সঙ্গে চুক্তিও হয়ে গেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গাইতে হতো বিটলসদের—কখনো কখনো ১০-১২ ঘণ্টা। কিছুটা নাম-ডাক হওয়ার পর প্রায় সাত দিনই তাঁদের গান গাইতে হতো। অন্যতম বিটলস জন লেনন পরে বলেছেন, হামবুর্গের সেই ক্লাবে গানের সুযোগ পাওয়ার ফলেই দল হিসেবে জমে ওঠে বিটলস। সে সময় কম করে হলেও ১০ হাজার ঘণ্টা তাঁরা গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বৈকি।
গেটস ও বিটলসের এই গল্প আমি পড়েছি ম্যালকম গ্লাডওয়েলের আউটলায়ার্স নামের একটি বই থেকে (লিটল, ব্রাউন অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৮)। এ রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে বইটিতে। তার সবগুলোর একটি মোদ্দা বক্তব্য: সাধনা ও পরিশ্রম ছাড়া জীবনে বড় ধরনের সাফল্য পাওয়া কঠিন। সফল এমন সব মানুষই কঠোর পরিশ্রম করেছেন, গ্লাডওয়েলের কথামতো, ১০ হাজার বা তার চেয়েও বেশি ঘণ্টা ব্যয় করেছেন তাঁরা। কিন্তু শুধু সাধনা ও পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়—প্রায় প্রতিটি সাফল্যের পেছনে রয়েছে সুযোগ (অপরচুনিটি)। একদম সাধারণ, তেমন উল্লেখ করার মতো কোনো ব্যাপার নয়, কিন্তু তাতেই সাফল্যের পথ খুলে যায়। আশপাশে মানুষ, যাদের গ্লাডওয়েল ‘কমিউনিটি’ নাম দিয়েছেন, তাঁরাই সে সুযোগ তৈরি করে দেন। বিল গেটস যদি ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোগ্রামিংয়ের সুযোগ না পেতেন, বিটলস দলের যদি হামবুর্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাওয়ার সুযোগ না আসত, তাহলে তাঁদের জীবনে এই অসম্ভব বাঁক ঘোরা কি সম্ভব হতো?
ম্যালকম তাঁর বইয়ে ক্রিস লানগ্যান নামে এক অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তির কথা বলেছেন। প্রতিভাবান, কিন্তু ব্যর্থ। সাধারণ মানুষের আইকিউ যেখানে ১০০, লানগ্যানের আইকিউ ১৯৮। তুলনা হিসেবে জানিয়ে রাখছি, বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আইকিউ ছিল ১৫০। ক্রিস দরিদ্র ঘরের সন্তান, ছোট বেলায় বাবা নিখোঁজ হন, মা সামান্য লেখাপড়া জানতেন, খুব ক্ষুদ্র একটি চাকরি করতেন। তার ছেলে যে প্রতিভাবান, এ কথা বোঝা সেই মায়ের পক্ষে অসম্ভব ছিল। কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য স্কলারশিপের আবেদন করেছিলেন ক্রিস, কিন্তু তাঁর মা আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে ভুলে যান, ফলে স্কলারশিপ ফসকে যায়। তার পরও মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন অঙ্ক ও দর্শন নিয়ে পড়তে। বাড়ি থেকে প্রায় ১৩ মাইল দূরে ক্লাস। যাতায়াত করতেন ভাঙা একটা গাড়িতে। একদিন সে গাড়ি অকেজো হয়ে গেলে ক্রিস তাঁর অধ্যাপককে অনুরোধ জানান, সকালের ক্লাসের বদলে সন্ধ্যায় ক্লাস করার সুযোগ তাঁকে দেওয়া হোক। এক প্রতিবেশী সন্ধ্যায় এদিকে আসেন, তিনি তাঁকে তাঁর গাড়িতে নিয়ে আসতে পারেন। রাজি হলেন না সেই অধ্যাপক। বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিলেন ক্রিস। এই লোকের কথা হয়তো আমরা জানতামই না, যদি না কয়েক বছর আগে ‘হু ওয়ান্টস টুবি মিলিয়নিয়ার’ টিভি অনুষ্ঠানে পাঁচ লাখ ডলার জিতে তিনি সাড়া না ফেলে দিতেন।
ম্যালকমের বক্তব্য, অসাধারণ প্রতিভাধর হওয়া সত্ত্বেও ব্যর্থ মানুষই হয়ে রইলেন ক্রিস লানগ্যান। যে সুযোগ বিল গেটস বা বিটলস পেয়েছিলেন, ক্রিস তা পাননি। পরিশ্রম তিনি কম করেননি, তাঁর একাগ্রচিত্ততারও কোনো অভাব ছিল না। সাফল্যের জন্য যে সিঁড়ি চাই, কেউ তাঁর পথ তাঁকে দেখিয়ে দেয়নি। জয়নাল আবেদিনের ব্যাপারটা অনেকটা তাই। তাঁর সাধনা ও পরিশ্রমের কোনো তুলনা নেই, কিন্তু বন্ধুপ্রতিম হাত না পেলে সাফল্যের সিঁড়ির খোঁজ তিনি কি পেতেন?
আরেকটি গল্প বলে এই লেখা আমি শেষ করব। গ্লাডওয়েলের বইটির কথা আমাকে জানান জিম্বাবুয়ের এক সহকর্মী। একদিন দুজন লাঞ্চ খেতে গেছি, সেখানেই বইটি নিয়ে কথা। হঠাৎ বন্ধুর মুঠোফোন বেজে ওঠে। কঙ্গোর একটি মেয়ে ফোন করেছেন, দেড় লাখ ডলারের একটি চাকরি তিনি পেয়েছেন, সে কথা জানাতেই ফোন। কিন্তু সে কথা তোমাকে জানাতে হবে কেন? জানতে চাইলাম। বন্ধুটি জানালেন, বছর দুয়েক আগে মেয়েটি তাঁর অফিসে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করতেন। সে সময় কথায় কথায় জানান, তাঁর ইচ্ছা আইনজীবী হওয়া, কিন্তু সে জন্য পরীক্ষা দিতে যে টাকা লাগে, তা তাঁর নেই। আমার বন্ধু ও তাঁর এক সতীর্থ মিলে সে টাকা জোগাড় করে দিই। এখন কৃতজ্ঞতা জানাতে সবার আগে তাঁকে এই ফোন।
আউটলায়ার্স বইটি পড়ে একটি বিষয় আমি শিখেছি। সাফল্য জিনিসটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আমরা নিজেরাই কখনো কখনো অন্যের সাফল্যের কারণ হতে পারি। এর জন্য চাই মনটাকে উদার করা, চাই অন্যকে সাহায্য করার জন্য মানসিকতা। একদম তুচ্ছ কাজ, আমাদের আয়ত্তের ভেতর যে কাজ, তার মাধ্যমেই কারও কারও জীবন আলোকিত হতে পারে। সে আলোয় আমরাও উজ্জ্বল হই। আরও একটি কথা। স্বার্থহীন কোনো কাজের মূল্য দাম দিয়ে কেনা যায় না। আমার জিম্বাবুয়ের বন্ধুর গর্বিত মুখটি দেখে আমি সে কথা ঠিক বুঝতে পেরেছি।
বন্ধু, প্লিজ, আপনার হাতটি বাড়ান।

Partner site : online news / celebrities /  celebrity image
website design by Web School.

0 comments to “হাত বাড়াও, বন্ধু”

Post a Comment